আদা বহুল পরিচিত একটি মশলা জাতীয় খাদ্য। খাবার টেবিলে আদাবিহীন সুস্বাদু খাবারের কথা কল্পনাই কর যায় না। তবে বাংলাদেশে চাহিদার তুলনায় আদার উৎপাদন তুলনামুলক কম। চাহিদা পূরণের জন্য প্রতি বছর বিদেশ থেকে প্রচুর আদা আমদানি করতে হয়। ভেষজ গুণ থাকায় আদা কাঁচা ও শুকনা দুভাবেই ব্যবহার করা যায়। বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আদার উৎপাদন বাড়িয়ে দেশের মানুষের চাহিদা মিটিয়ে আদা বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব।
আদার ভেষজ ও পুষ্টিগুণ
ক) আদার রস শরীর শীতল করে এবং হার্টের জন্য উপকারী।
খ) কাশি এবং হাঁপানির জন্য আদার রসের সাথে মধু মিশিয়ে সেবন করলে বেশ উপশম হয়।
গ) ঠান্ডায় আদা ভীষণ উপকারী। এতে রয়েছে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল এজেন্ট, যা শরীরের রোগ-জীবাণুকে ধ্বংস করে। জ্বর জ্বর ভাব, গলাব্যথা ও মাথাব্যথা দূর করতে সাহায্য করে।
ঘ) মাইগ্রেনের ব্যথা ও ডায়াবেটিসজনিত কিডনির জটিলতা দূর করে আদা। গর্ভবতী মায়েদের সকালবেলা, বিশেষ করে গর্ভধারণের প্রথম দিকে সকালবেলা শরীর খারাপ লাগে। কাঁচা আদা দূর করবে এ সমস্যা।
ঙ) দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে, আদার রস দাঁতের মাড়িকে শক্ত করে, দাঁতের ফাঁকে জমে থাকা জীবাণুকে ধ্বংস করে।
চ) দেহের কোথাও ক্ষতস্থান থাকলে তা দ্রুত শুকাতে সাহায্য করে আদা। এতে রয়েছে অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরি এজেন্ট, যা যেকোনো কাটাছেঁড়া, ক্ষতস্থান দ্রুত ভালো করে।
ছ) রক্তের অনুচক্রিকা এবং হৃদযন্ত্রের কার্যক্রম ঠিক রাখতেও আদা দারুণ কার্যকর। মুখের রুচি বাড়াতে ও বদহজম রোধে আদা শুকিয়ে খেলে বাড়বে হজম শক্তি।
জ) আমাশয়, জন্ডিস, পেট ফাঁপা রোধে আদা চিবিয়ে বা রস করে খেলে উপকার পাওয়া যায়। এছাড়া যারা গলার চর্চা করেন তাদের গলা পরিষ্কার রাখার জন্য আদা খুবই উপকারী।
ঝ) ঠান্ডায় টনসিলাইটিস, মাথাব্যথা, টাইফয়েড জ্বর, নাক দিয়ে পানি পড়া, নাক বন্ধ হওয়া, বসন্তকে দূরে ঠেলে দেয় আদা। ওভারির ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই করে আদা।
ঞ) বমি বমি ভাব দূর করতে এর ভূমিকা অপরিহার্য। তাই বমি বমি ভাব হলে কাঁচা আদা চিবিয়ে খেতে পারেন। এতে মুখের স্বাদ বৃদ্ধি পায়।
ট) অসটিও আর্থ্রাইটিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস-এই অসুখগুলোয় সারা শরীরের প্রায় প্রতিটি হাড়ের জয়েন্টে প্রচুর ব্যথা হয়। এই ব্যথা দূর করে আদা। তবে রান্না করার চেয়ে কাঁচা আদার পুষ্টিগুণ বেশি।
আদাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পুষ্টিগুণ রয়েছে। আদায় ক্যালসিয়াম ও প্রচুর ক্যারোটিন । শুকনা আদায় শতকরা ৫০ ভাগ শর্করা, ৮.৬ ভাগ আমিষ, ৫.৯ ভাগ আঁশ, ০.১ ভাগ ক্যালসিয়াম, ১.৪ ভাগ পটাশিয়াম আছে। এছাড়া প্রতি ১০০ গ্রাম আদায় ১৭৫ গ্রাম ভিটামিন ‘এ´ এবং ৩৮০ ক্যালরি খাদ্যশক্তি আছে। আরও পড়ুনঃ ঢেঁড়সের পুষ্টিগুণ
আদার জাত
আমাদের দেশে আদার স্থানীয় অনেক জাত রয়েছে। আদার সেসব জাতের মধ্যে বারি আদা-১ অন্যতম। এটি উচ্চফলনশীল জাত। গাছের উচ্চতা প্রায় ৮০ সেমি। প্রতি গোছায় পাতার সংখ্যা ২১-২৫টি এবং পাতাগুলি আংশিক খাড়া প্রাকৃতির। প্রতি গোছায় টিলারের সংখ্যা ১০-১২টি। প্রতিটি গোছায় রাইজোমের ওজন ৪০০-৪৫০ গ্রাম। প্রচলিত জাতগুলির চেয়ে এর ফলন তুলনামূলকভাবে বেশি। স্থানীয় জাতের মতো বারি আদা-১ সহজে সংরক্ষণ করা যায়। বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকাতেই আদার এ জাতটি চাষ করা সম্ভব।
আবহাওয়া ও মাটি
আদার জন্য উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া দরকার । আংশিক ছায়াযুক্ত স্থানে আদা ভাল হয় ।
উর্বর দো-আঁশ মাটি আদা চাষের জন্য সবচেয়ে ভাল । তবে এঁটেল মাটিতে চাষ করলে পানি নিষ্কাশনের খুব ভাল ব্যবস্থা থাকতে হবে ।
মার্চ-এপ্রিল মাসে বৃষ্টি হওয়ার পর জমি যখন জো অবস্থায় আসে তখন ৬-৮ টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করা হয় । এরপর ৪ মিটার দৈর্ঘ্য ও ২ মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট বেডের চারিদিকে পানি সেচ ও নিষ্কাশনের সুবিধার জন্য ৫০ সেমি. চওড়া নালা তৈরি করতে হবে ।
সার প্রয়োগ
কৃষি পরিবেশ অঞ্চলের উপর সারের পরিমান নির্ভর করে । বেশি ফলন পেতে হলে আদার জমিতে প্রচুর পরিমাণ জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে ।
আদার জন্য প্রতি হেক্টরে নিম্নে উল্লিখিত হারে সার প্রয়োগ করতে হবে-
গোবর – ৫-১০ টন
ইউরিয়া – ৩০০ কেজি
টিএসপি – ২৭০ কেজি
এমওপি/পটাশ – ২৩০ কেজি
জিপসাম – ১১০ কেজি
দস্তা – ৩ কেজি
সার প্রয়োগ পদ্ধতি
সম্পূর্ণ গোবর এবং টিএসপি, জিপসাম, দস্তা এবং অর্ধেক এমওপি (পটাশ) সার জমি তৈরির সময় মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
বীজ বপনের সময়
এপ্রিল থেকে মে মাসে আদা বপন করা যায়। তবে এপ্রিলের শুরুতে আদা লাগালে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
বীজ হার (বিঘা প্রতি)
আদার ফলন অনেকাংশে বীজের আকারের ওপর নির্ভর করে। বীজ আদার আকার বড় হলে ফলন বেশি হয়। ৩৫-৪০ গ্রাম আকারের বীজ রোপণ করলে আদার ফলন বেশি পাওয়া যায়। এজন্য বীজ রাইজোমকে সাবধানে ২.৫-৫ সেমি. দৈর্ঘ্যের দুই চোখ বিশিষ্ট ৩৫-৪০ গ্রাম ওজনের খন্ডে কেটে নিতে হবে। তবে খরচের কথা বিবেচনা করলে তুলনামূলকভাবে ছোট (২০-৩০ গ্রাম) আকারের বীজ ব্যবহার করা যেতে পারে। এ আকারের বীজ রোপণ করলে বিঘা প্রতি ২১০-৩২০ কেজি আদার প্রয়োজন হয়। জেনে নিন চালকুমড়ার চাষপদ্ধতি।
বীজ শোধন
প্রায় ৮০ লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম ডাইথেন এম-৪৫ বা ৮০ গ্রাম ব্যাভিস্টিন বা ১৬০ গ্রাম রিডোমিল গোল্ড এম জেড-৪৫ মিশিয়ে তার মধ্যে ১০০ কেজি আদা ৩০-৪০ মিনিট ডুবিয়ে শোধন করতে হবে। এ বীজ ছায়াযুক্ত স্থানে খড় বা চট দিয়ে ঢেকে রাখলে ভ্রুন বের হয়, যা জমিতে বপন করতে হয়।
বীজ বপন
একক সারি পদ্ধতিঃ সারি – সারি= ২০ ইঞ্চি., গাছ – গাছ= ১০ ইঞ্চি।
দুই সারি পদ্ধতিঃ এক বেডে দুই সারির দূরত্ব= ২০ ইঞ্চি এবং গাছ – গাছ= ১০ ইঞ্চি, গভীরতা=২.০-২.৫ ইঞ্চি
বীজ আদা রোপনের সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে সব আদার অংকুরিত মুখ একদিকে থাকে। কারণ ৭৫-৯০ দিন পর এক পাশের মাটি সরিয়ে পিলাই (বপনকৃত আদা) সংগ্রহ করা যায়। এতে ৬০-৭০% খরচ উঠে আসবে।
আদার পরিচর্যা
বপনের ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যে আদার গাছ বের হবে। বপনের ৫-৬ সপ্তাহ পর আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। আদার বৃদ্ধি ও পানি নিষ্কাশনের জন্য দুই সারির মাঝের মাটি ২-৩ বারে তুলে দিতে হবে। অনেক সময় মালচিং করলে ভাল হয়। জমিতে ছায়াদানকারী হিসেবে ধৈঞ্চা, বকফুল লাগানো যেতে পারে। সমস্ত গাছ ১.৫-২.০ মিটার লম্বা হলে আগা কেটে দিয়ে শাখা প্রশাখা বৃদ্ধি করে ছায়ার ব্যবস্থা করা। এছাড়া আদার জমিতে লাউ, শিম, পটল লাগিয়ে বাড়তি আয় করা যায়।
উপরি সার প্রয়োগ (১)
অর্ধেক ইউরিয়া (১৫০ কেজি) ও বাকী পটাশের অর্ধেক (৫৭.৫ কেজি) ৫০ দিন পর প্রতি হেক্টর জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
পিলাইতোলা
আদা রোপণের পর গাছও শিকড় গজিয়ে গেলে বীজ আদা তুলে নেওয়া যায়।
এতে গাছের বৃদ্ধিতে তেমন কোন ক্ষতি হয় না।
এ থেকে উত্তোলিত বীজ আদা বিক্রি করে কিছু আর্থিক লাভ হয়।
এই পদ্ধতিটিকেই পিলাই তোলা বলে।
উপরি সার প্রয়োগ (২)
৭৫ কেজি ইউরিয়া ও ২৮.৭৫ কেজি পটাশ ৮০ দিন পর প্রতি হেক্টর জমিতে দ্বিতীয় উপরি প্রয়োগ করতে হবে ।
উপরি সার প্রয়োগ (৩)
৭৫ কেজি ইউরিয়া ও ২৮.৭৫ কেজি পটাশ ১০০ দিন পর প্রতি হেক্টর জমিতে তৃতীয় উপরি প্রয়োগ করতে হবে ।
আদা সংগ্রহ
কন্দ রোপনের ৯-১০ মাস পর পাতা শুকিয়ে গেলে সংগ্রহ করতে হয়। সাধারণত ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে কোদাল দিয়ে মাটি আলাদা করে আদা উত্তোলন করা হয়। ফসল সংগ্রহের পর মাটি পরিষ্কার করে আদা সংরক্ষণ করা হয়। জেনে নিন মাইক্রোগ্রিনের চাষপদ্ধতি।
সংরক্ষণ
আদা উঠানোর পর বড় আকারের বীজ রাইজোম ছায়াযুক্ত স্থানে বা ঘরের মেঝেতে বা মাটির নিচে গর্ত করে গর্তের নিচে বালির ২ ইঞ্চি পুরু স্তর করে তার উপর আদা রাখার পর বালি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। পরে খড় বিছিয়ে দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। এতে আদার গুনাগুন এবং ওজন ভাল থাকে। গর্তে সংরক্ষণ করার পূর্বে বীজ আদা ০.১% কুইনালফস এবং ০.৩ % ডায়াথেন এম-৪৫ এর দ্রবণে শোধন করা হয়। উক্ত দ্রবণ থেকে উঠিয়ে রাইজোম ছায়ায় শুকানো হয়। গর্তের দেওয়ালের চারিদিকে গোবরের তৈরী পেস্ট দিয়ে প্রলেপ দিয়ে শুকিয়ে আদা রাখা হয়। আদার প্রতি স্তরের উপর ২ সেমি. পুরু শুকনো বালি বা করাতের গুড়া দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। বায়ু চলাচলের জন্য গর্তের উপরিভাগে ও পাশে পর্যাপ্ত পরিমাণ ফাঁকা জায়গা রেখে দেওয়া হয়।
- বাংলাদেশে পঙ্গপাল আক্রমণের সম্ভাবনা - July 10, 2020
- রকমেলন চাষ ও এর পরিচর্যা - July 6, 2020
- ঘরোয়া উদ্ভিদের রোগ-বালাই নিয়ন্ত্রণ – দ্বিতীয় পর্ব - July 3, 2020