Skip to content

ফুল গল্প

আমরা কাউকে শুভেচ্ছা জানাতে ফুল দেই, কাউকে জন্মদিনের গিফট হিসেবে ফুল দেই আবার যখন কাউকে বোঝাতে পারিনা যে আমরা তাকে কতটা ভালোবাসি! তখন ওই একগুচ্ছ ফুলই আমাদের হয়ে না বলা অনুভুতিগুলো প্রকাশ করে। প্রেমিকার হাতে ধরে রাখা ফুলটা সফলতার গল্প বোনে, আবার প্রেমিকের ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলা ফুলটা ব্যর্থতার গল্পও বোনে। কিছু ফুল অযত্নে রাস্তায় পড়ে থাকে, কিছু ফুল আবার যত্নে খোপায় তুলে নেয় কেউ কেউ। মানুষ বদলায়, আবেগ বদলায়, সময় বদলায় এমনকি গল্পগুলোও বদলে যায়। শুধুমাত্র “ফুলগুলো” একইরকম থেকে যায়। 

তাই আজকে কিছু “গল্পের” ঘ্রাণ নেই আর কিছু ফুল “পড়ি”…… 🌻🖤

১. নীলকণ্ঠ

মিথিলার মন খারাপ। বাবা’র সন্ধ্যার চায়ে চিনি বেশি হয়েছে বলে বকা খেয়ে মন খারাপ, তেমন মন খারাপ না। একদম গালভর্তি করে কান্নাকাটি করার মত মন খারাপ। সে মন খারাপটাকে খানিকটা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বাগানে এসে বসলো। বাগানটাতে হরেক রঙের ফুলে ভরা। কিন্তু মিথিলা নীল রঙের ফুল খুঁজছে। সে কোথায় যেন পড়েছে যে নীল হলো মন খারাপের রং! তাই সে খুঁজে খুঁজে নীলরঙা ফুলগুলো কুড়িয়ে নিলো!

Nilkontho
নীলকণ্ঠ

কিন্তু আশ্চর্য! মন ভালো হয়ে যাচ্ছে কি করে? 

২. নয়নতারা

তারিক সাহেবের খুব ইচ্ছে যে মেয়ে হলে তার নাম রাখবেন “তারা”। ঘর আলো করে রাখবে তার মেয়ে। তাই নাম “তারা”। তার স্ত্রী মুচকি হেসে “তারা’র আব্বু” বলে টিপ্পনি করতেন তাকে। বিয়ের পরে পনেরোটা বসন্ত ঘুরে গেলো তবুও “তারা” আসলো না। তবে এখনো তারিক সাহেবকে তার স্ত্রী “তারা’র আব্বু” বলেই ডাকেন!

Noyontara 2
নয়নতারা

সৃষ্টিকর্তা যে প্রতি শীতে তারিখ সাহেবের বাগান “নয়নতারা” ফুলে ভরিয়ে দেন, সেটা কি সত্যিই কাকতালীয়? 

৩. মোরগফুল

আচ্ছা উঠোনের মোরগগুলো কি জানে যে তাদের নামে একটা ফুল আছে?

প্রকৃতি এত বড় একটা ঘটনা এভাবে চেপে গেলো? নাকি মোরগগুলো জেনে গেলে তারা মুরগীগুলোকেও জানিয়ে দেবে! পরে “মুরগীফুল” নেই কেন বলে মোরগ-মুরগীর মাঝে একটা হাঙ্গামা হবে জন্য প্রকৃতি ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দিয়ে দিলো?

Morog ful
মোরগ ফুল

৪. ক্যালেন্ডুলা

প্রথম উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের ল্যাব এক্সাম। বরাবরই শুনে আসছি যে এই ডিপার্টমেন্ট নাকি খুবই কড়া! আর এদিকে আমি এমন একটা মানুষ যে কিনা ফুলই চিনিনা! সেই মানুষটাই গোটা বিশেক বৈজ্ঞানিক নাম মুখস্ত-টুখস্ত করে একাকার। তো একটা সময় আমারও ডাক পড়লো। যেয়ে বসা মাত্রই স্যার জিজ্ঞেস করলেন “বলো তোমার পছন্দের ফুলের নাম কি”। আমি ধুপ করেই বলে ফেললাম ” স্যার ক্যালেন্ডুলা”। স্যারের চোখে মুখে বিষ্ময়, খুবই অবাক হলেন স্যার। তার থেকেও বেশি অবাক ছিলাম আমি! কেননা আমি নিজেও জানিনা, এত হাজার ফুল থাকতে কেন আমি ক্যালেন্ডুলা’র নাম নিলাম! স্যার এবার জিজ্ঞেস করলেন ক্যালেন্ডুলা কেন আমার পছন্দের ফুল? আমি এবার নিজেকে আরেকবার ছাড়িয়ে যেয়ে উত্তর দিলাম “কারন স্যার এটা সূর্যমুখীর মত দেখতে”! স্যার হতাশ হয়ে আবার বললেন, সূর্যমুখী থাকতে, সূর্যমুখীর মত দেখতে ফুল কেন পছন্দ?..

Calendula
ক্যালেন্ডুলা

আমার মনে হতে লাগলো আমি অনন্তকাল থেকে মাথা চুলকাচ্ছি আর স্যার অনন্তকাল থেকে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন!  

৫. পলাশ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে গেছি! মাঝে মাঝেই অবশ্য আমরা যাই। কখনো ক্লাসফাঁকি দেয়ার জন্য যাই, কখনো বা বটতলার ভর্তা দিয়ে ধোয়া ওঠা ভাত খেতে। আবার মাঝে মাঝে “উদাস” হওয়ার জন্যও যাওয়া হয়। নাম ঠিকানা না জানা ক্যাম্পাসের কোন এক চত্বরে বসে আছি। এমন সময় চোখ পড়লো দূরে এক গাছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে এমন একটা গাছ।

Shimul
পলাশ

ভয় পেয়ে গেলাম আমি। পাশ ফিরে দেখি সব বন্ধুবান্ধব দৌড় দিচ্ছে সেই আগুনের দিকে। আমিও একছুটে যেয়ে দেখি গাছভর্তি আগুন! এমনকি নিচেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আগুন জ্বলছে। এমন সময় হাত ভর্তি করে আগুন তুলে এক বন্ধু বললো মুহুর্তটাকে স্থির করে দে! 

ছবি তুলে দেখি! এতো “পলাশ ফুল”…

৬. সূর্য ফুল

এক সকালে উঠে দেখি সূর্যটা ধুপ করে ফুল হয়ে গেছে। ভোরবেলাতে খানিকটা সুবাস পেলেও, বেলা যতটা গড়াচ্ছিলো সেই সুগন্ধটা আরো গাঢ় হচ্ছিলো! ভর দুপুরে ফুলের গন্ধে চারিদিকে ম ম করছে। এমন সময় চারুকলা ভবনের সামনে এসে দেখি জটলা! কাছে যেতেই শুনি রাহুল দা’ গাইছেন “এমন যদি হতো আমি সূর্য ফুলের মত”…

Surjo Ful
সূর্য ফুল

আর সবাই সূর্যের ঘ্রাণে আচ্ছন্ন হয়ে গলা মেলাচ্ছেন দাদা’র সাথে।

৭. সাদা রঙ্গন

তখন সবেমাত্র ফেসবুকে এসেছি! সব কিছুই নতুন নতুন। একদিন হুট করেই দেখি ফেসবুক আমাকে ডেকে বলছে(people you may know), এই “Ixora coccinea” কে কি চেনেন আপনি? আমি দুই-তিন ইনস্টলমেন্টে নাম উচ্চারণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলাম। তবে কৌতুহল জাগলো কিছুটা। তাই ঝটপট রিকোয়েস্ট দিয়ে ফেললাম। রিকোয়েস্ট দেয়ার দিন দুয়েক বাদে যখন ফ্রেন্ডলিস্টে ঢুকে গেলাম। তারপর সাথে সাথেই “এই Ixora coccinea মানে কি?” লিখে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। ফিরতি ম্যাসেজে আপুটা আমার আচার-আচরণ নিয়ে যেই ক্লাসটা নিয়েছিলো সেটা কোনদিনও ভুলবোনা। রীতিমতো ঘন্টাখানেক টানা বকা খাওয়ার পরে আমি দুটো জিনিস বুঝতে পেরেছিলাম।

White Rongon
শুভ্র রঙ্গণ
  • অপরিচিত কাউকে নক দেয়ার সময় কিছুটা আদব কায়দার সহিত কথা বলতে হয়!

আর 

  • এইসব “Ixora coccinea” টাইপ প্রশ্নের উত্তর গুগলেই পাওয়া যায়!

যাই হোক! সেই আপুর সাথে পরে আমার সখ্যতা হয়ে গিয়েছিল। এবং আশ্চর্যজনকভাবে এখনো আপুর সাথে আমার টুকটাক কথা হয়! আর প্রায় এক সপ্তাহ ঘুরানোর পরে উনি আমাকে জানিয়েছিলেন যে “Ixora Coccinea” মানে “রঙ্গন ফুল”। 

৮. শুভ্র জবা

জীর্ণ-শীর্ণ চিঠিটার সবগুলো পাতা এলোমেলো! প্রতিটা শব্দ কত হাজার বার করে যে পড়া হয়েছে তার হিসেব নেই। তারপরেও শুভ্র প্রতি রাতে একবার করে চিঠিটা বের করে। চোখ বুলায় চিঠিতে, প্রতিটা অক্ষর ছুঁয়ে দেখে। কিন্তু প্রতিরাতেই চোখ আটকে যায় “ভালো থেকো শুভ্র” তে। এতগুলো বছর পরেও শুভ্র এই “ভালো থেকো” লিখাটা দেখলে আর ভালো থাকতে পারেনা। তারপরেও সে প্রতিরাতে লিখাটা দেখে। হয়তো সে ভালো থাকতে চায়না অথবা ভালো না থাকার অভ্যাস হয়ে গেছে! কে জানে! প্রকৃতি খুবই রহস্যময় আর মানুষের মন তার থেকেও বেশি!

White Joba
শুভ্র জবা

আচ্ছা শুভ্র কি কখনো খেয়াল করেছে, প্রতিটা চিঠির শেষে লিখা ছিল “ইতি তোমারই জবা”.. আর শেষ চিঠিটাতে লিখা “ইতি জবা”? 

১০. রক্ত জবা

পিচ্চিকালে একুশে ফেব্রুয়ারি মানেই ছিল পাটকাঠি দিয়ে শহীদ মিনার বানানো। কে কত সুন্দর করে বানাতে পারে। সেটা নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলতো। এরকমই একবার শহীদ মিনার বানানো শেষ। কিন্তু পেছনের যে লাল রঙের চাকতি সেটা রং করার জন্য লাল রং নেই। পুরো ঘর তন্ন তন্ন করেও একটা লাল রঙ পেন্সিল পাওয়া গেলো না। আমি তো গাল ফুলিয়ে, টলটলে চোখে বসে আছি। এমন সময় আব্বু ডাক দিচ্ছিলো। যেয়ে দেখি আব্বু লাল রঙের কি জানি খাতায় ঘষে ঘষে লাল রঙ করছেন। আমি হা করে তাকিয়ে আছি আর দেখছি আব্বুর আঙ্গুল গলে গলে লাল রং পড়ছে কাগজে!

Red Joba 1
রক্ত জবা

পরে অবশ্য আমিও যখন লাল রং পেতাম না তখন “রক্ত জবা” দিয়েই কাজ চালিয়ে নিতাম!

১১. রেইন লিলি

এনসাইক্লোপিডিয়ার সাথে পরিচয় তো অনেক পরে হয়েছে। ছোটবেলায় আমাদের এনসাইক্লোপিডিয়া ছিল আমাদের ছোটমামা। ইহজাগতিক এমন কোন প্রশ্নের উত্তর নেই, যেটা তার অজানা। তার কাছে থেকেই প্রথম আমরা জেনেছিলাম যে হাওয়াই মিঠাই বানানোর যন্ত্রের ভেতরে বিশাল বিশাল কয়েকটা মাকড়সা থাকে। যারা চিনির দলাগুলো দিয়ে জাল বানায়! আর সেই জালই আমরা খাই। তো এরকমই একদিন আমরা হাটছিলাম। সামনে সাদা রঙের ফুল দেখে জিজ্ঞেস করলাম মামা এই ফুলের কি নাম? মামা একগাল হেসে বললো, এটা হলো “গুড়চিতই” ফুল! আমরাও বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিলাম। আর ভাবতে লাগলাম মামা কত জ্ঞানী মানুষ! আমরা এরকম একজন জ্ঞানী মানুষের ভাগ্না ভাগ্নী। এই ভেবেই গর্বে বুকটা ফুলে যাচ্ছিলো!

White Rain Lilly
রেইন লিলি

তারপর অনেক অনেক বছর পরে যখন আমি জানতে পারলাম যে “গুড়চিতই” ফুল বলে কিছুই নেই। মামা যেটাকে দেখিয়েছিল, সেটা আসলে “রেইন লিলি”। তখন মামা হো হো করে হেসে বলেছিল, আসলে সেই মুহূর্তে মামা গুড় দিয়ে চিতই পিঠা খাচ্ছিলো আর মামা গাছ-ফুল তেমন চিনতোও না। তাই কোন কিছু চিন্তা না করেই ” গুড়চিতই” ফুল নাম দিয়ে দিয়েছিল!

মামা যে এরকম কত হাবিজাবি জিনিস আমাদেরকে শিখিয়েছিল তার হিসেব নেই। তবে এখনো আমরা “রেইন লিলিকে” “গুড়চিতই” নামেই ডাকি! 

ছবিয়াল ও গল্পকারঃ নাহিদ হাসান, শিক্ষার্থী, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

Nahid Hasan
Follow Me
Latest posts by Nahid Hasan (see all)

2 thoughts on “ফুল গল্প”

    Advertisements

Leave a Reply