মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় খনিজ উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি পটাশিয়াম। এটি মাংসপেশি এবং স্নায়ুর কার্যক্ষমতা সচল রাখতে সাহায্য করে। শরীরে ইলেক্ট্রোলাইট এবং অম্ল-ক্ষারের ভারসাম্য বজায় রাখে। সেই সঙ্গে কমায় উচ্চ রক্তচাপের আশঙ্কা। শরীরের জন্য সেই প্রয়োজনীয় পটাশিয়ামের একটি চমৎকার উৎস কলা এবং নাস্তার জন্য খুবই ভালো একটি খাবার।
কলার খাওয়ার সময় অনেকের কাছে বিরক্তিকর বিষয়টা হচ্ছে, কলায় লেগে থাকা সুতাকৃতির চামড়া যেটিকে ‘ফ্লোয়েম বান্ডেল’ নামে বিজ্ঞানের ভাষায় অভিহত করা হয়ে থাকে।
খোসা ছাড়ানোর পর কলায় ফ্লোয়েম বান্ডেল লেগে থাকতে দেখা যায়। অধিকাংশ মানুষ বিরক্তির সহকারে কলা থেকে সেই ফ্লোয়েম বান্ডেল ফেলে দিয়ে তারপর সেই কলা খেয়ে থাকে। এই ফ্লোয়েম বান্ডেলগুলো খেতে সুস্বাদু না হলেও, খাওয়াটা কিন্ত আসলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো ফেলে দিয়ে কলা খাওয়াটা মোটেও উচিত হবে না – এমনটাই জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউট্রিশন রিসার্চের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ডোল নিউট্রিশন ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. নিকোলাস ডি গিলিট। হাফিংটন পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানিয়েছেন।
ড. গিলিট বলেন, যদিও আমরা নির্দিষ্টভাবে ফ্লোয়েম বান্ডেল নিয়ে গবেষণা করিনি, তবে সম্ভবত এর পুষ্টিগুণের মধ্যে পার্থক্য থাকবে। যেহেতু এগুলো একটি নির্দিষ্ট কাজ করার জন্য তৈরি। কলার তুলনায় ভিন্ন পুষ্টিগুণ এতে রয়েছে বলে আশা করা যায়। ফ্লোয়েম টিস্যুর কাজের দিকে তাকিয়েই এর পুষ্টিগুণ সম্পর্কে ধারণা করা যায়। ফ্লোয়েম টিস্যু উদ্ভিদের দুই ধরনের পরিবহন টিস্যুর একটি, যা সকল উদ্ভিদের মধ্যেই রয়েছে। পুষ্টি এবং অন্যান্য উপাদান পুরো উদ্ভিদে পরিবহন করে এই টিস্যু। কলার মধ্যে ফ্লোয়েম থাকার কারণ হচ্ছে, এটি পুষ্টিগুলো পুরো কলায় ছড়িয়ে দেয়, যা কলার বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। পুষ্টির পর্যাপ্ত স্বভাবের জন্য ফ্লোয়েম বান্ডেলগুলো প্রয়োজন। ড. গিলিটের মতামত, কলার ফ্লোয়েম বান্ডেলগুলো সম্পূর্ণরূপে খাওয়া যেতে পারে এবং ফলের মূল অংশ হিসেবে তা পুষ্টিকরভাবে সমৃদ্ধ। এমনকি সম্ভবত পুরো কলার তুলনায় এর ফ্লোয়েম বান্ডেলে অনেক বেশি ও বিভিন্ন ধরনের ফাইবার রয়েছে। আর যেকোনো ফাইবার মানেই স্বাস্থ্যকর। মানুষের শরীরের জন্য এটি ভিন্ন প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও ভিটামিন যোগাবে যেমন-ভিটামিন-বি৬, ফাইবার, ভিটামিন-এ।
আরও পড়ুনঃ মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে কলার খোসা থেকে উৎপাদিত সার
এই ফল বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, ‘সাধারণত ফলের সব অংশই পুষ্টিকর। আপেল, নাশপাতি অন্যান্য ফলগুলো খোসা সহ খাওয়া হয়ে থাকে এবং ফ্লোয়েম বান্ডেল তো অবশ্যই চাইলে খোসা সহও কলা খাওয়া যেতে পারে। বে স্বাদ হলেও, এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণায় এদের ক্ষতিকারক বলে প্রমাণ করা যায়নি বরং খেতে উৎসাহিত করে হয়েছে।
কলার আরও সাতটি উপকারিতা
ক) কলা আমাদের তাৎক্ষণিক শক্তি প্রদান করে। কলাতে প্রচুর পরিমাণে ক্যালরি রয়েছে, জা কিনা একজন পূর্ণ মানুষকে ৯০ মিনিট পর্যন্ত কাজ করার শক্তি প্রদান করে। ৭ ইঞ্চি আকৃতির কলায় রয়েছে ১০৫ ক্যালরি।
খ) কলা আমাদের রক্তের শর্করার পরিমাণ যথাযথ রাখে। গ্লাইকেমিক ইনডেক্স (Glycemic Index or GI) এর সর্বোচ্চ স্তরের খাবারগুলো আমাদের রক্তে শর্করার পরিমাণকে বাড়ায়। কলা ধীরে ধীরে রক্তের স্রোতকে শোষণ করে যা কিনা শর্করার পরিমাণ বৃধি করা, মুড সুইং করার মতো সমস্যাগুলোকে দূর করে।
গ) কলা আমাদের স্বাস্থ্যকে সুস্থ রক্তচাপ রক্ষার্থে সাহায্য করে। কলায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম ও খুব অল্প পরিমাণে সোডিয়াম। একটি মাঝারী আকৃতির কলায় ৪২২ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম রয়েছে। যা কিনা ১.২ মিলিগ্রাম সোডিয়ামের সমান। যা কিনা রক্তনালী গাত্রকে চাপমুক্ত রাখে এবং হাইপারটেনশন থেকে রক্ষা করে।
ঘ) কলা আমাদের সচল হৃদপিণ্ড বজায় রাখতে সহায়তা করে। আঁশ, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-বি ৬ ও পটাশিয়াম সুস্থ হৃদপিন্ড বজায় রাখার জন্যে সুপরিচিত। এক গবেষণায় বলা হয় যারা প্রতিদিন ৪০৬৯ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম গ্রহণ করে তাদের আকস্মিক হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা ৪৯ ভাগ ক্ষীণ। দৈনিক চাহিদার এই পটাশিয়াম একমাত্র কলা গ্রহণ থেকেই আমরা পেতে পারি।
ঙ) কলা হজমযন্ত্রের ক্রিয়ার সঠিকতা বজায় রাখতেও কার্যকরী ভূমিকা রাখে। আঁশ কৌষ্ঠকাঠিণ্য থেকে রক্ষা করে। কলায় র্যেছে প্রচুর পরিমাণে আঁশ। মাঝারী সাইজের একটি কলায় ৩ গ্রাম আঁশ থাকে। দৈনিক আঁশের চাহিদা পুরুষ ও নারীদের ক্ষেত্রে যথাক্রমে ৩৮ ও ২৫ গ্রাম।
চ) কলা পাকস্থলীর আলসার হতেও রক্ষা করে। কলাকে এন্টাসিডের অর্গানিক সমাধান হিসেবে ধরা হয়। যা কিনা এসিড নিঃসরণ কমিয়ে দেয়। লিউকোসায়ানিডিন নামক একটি যৌগ যা কিনা কলায় বিদ্যমান, পাকস্থলীর কোষগুলোকে উদ্দীপ্ত করে একটি আত্মরক্ষাকারী বাধা তৈরি করে। এছাড়াও এটি ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে নষ্ট করে দেয় যা আলসার হওয়ার জন্যে দায়ী হিসেবে পরিচিত।
ছ) কলা আপনাকে রাত্রে ভাল ঘুম হতেও সাহায্য করে। কলায় রয়েছে ম্যাগনেশিয়াম যা কিনা ভাল ঘুমুতেও সাহায্য করে আমাদের। ম্যাগনেশিয়ামের সাথে ভাল ঘুম হওয়া, উন্নতি করা, ঘুমের সময় ইত্যাদি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইনসোমনিয়া প্রতিরোধ করতেও কলার রয়েছে কার্যকরী ভূমিকা। গবেষণায় বলা হয়েছে যে, কলা রক্তে মেলাটনিনের লেভেল বৃদ্ধি করে একটি শান্তির ঘুম আনয়নে সহযোগীতা করে।
তো কি ভাবছেন? সুস্থ থাকতে কি আজ থেকেই নিয়মিত ২-৩টি কলা খাবেন তো?
আরও পড়ুনঃ সৌন্দর্য্যচর্চায় শীতকালীন সবজি ও ফল | কলা | দ্বিতীয় পর্ব
- স্বাদ অক্ষুণ্ণ রেখে গোশত সংরক্ষণের উপায় - July 21, 2021
- পেঁয়াজের রোগ-বালাই ও এর দমন ব্যবস্থা – পর্ব ২ - July 18, 2021
- পেঁয়াজের রোগ-বালাই ও এর দমন ব্যবস্থা – পর্ব ১ - July 18, 2021