জনপ্রিয় সবজি হিসেবে আলুর নাম সবার আগেই আসবে। আলু দিয়ে কি না হয়! আলুভাজা, আলুর চপ, আলুর দম, আলুভর্তার মত মুখোরোচক খাদ্য সবাই আলু দিয়েই তৈরি। মাংসের তরকারিতে আলু না দিলে তরকারি যেন পানসে হয়ে যায়।
ধরা হয়ে থাকে আলু আমেরিকায় প্রথম পাওয়া যায়। স্পেনের বিখ্যাত নাবিক কলাম্বিয়ার আমেরিকা পৌঁছানোর পূর্বেই আলুর চাষাবাদ করা হত। আমেরিকান আদিবাসীদের প্রধান খাদ্যই ছিল এই আলু। স্পেন উপনিবেশ কায়েম করলে প্রথম এই আলু পেরু থেকে ইউরোপে প্রবেশ করে। স্পেন দিয়ে শুরু হলেও পরবর্তীতে সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পরে ষোল শতকের মধ্যে। এটি পরবর্তীতে উত্তর আমেরিকায় ইউরোপীয় উপনিবেশকরা নিয়ে আসে। আয়ারল্যান্ডে আঠারো শতকে আলুই হয়ে যায় প্রধান খাদ্য। সাধারণ আলু মিষ্টি আলুর চেয়ে ভিন্নরকম হলেও একসময় মিষ্টি আলুকেও আলাদা না করে আলু বলেই প্রচার করা হত। দুইটি বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপের প্রধাণ খাদ্যই ছিল এই আলু। জার্মান শিবিরে শক্তির উৎস হিসেবে আলুই প্রধান ছিল। এই আলুই পরবর্তীতে সমগ্র ইউরোপীয়ানদের প্রধান খাদ্যদ্রব্যে পরিণত হয়।
এই উপমহাদেশেও আলু এসেছে উপনিবেশকদের হাত ধরে। চর্যাপদ বা সুলতানদের যুগে এই উপমহাদেশ আলু চিনত না। পর্তুগীজ নাবিকরা প্রথম আলু নিয়ে আসে সম্ভবত সতের শতকে দিকে। ১৮৪৭ সালে ব্রিটিশ ম্যাগাজিন The Gardening Monthly থেকে ভারতে আলু চাষের ব্যাপারে প্রথম প্রতিবেদন বের হয়। এই বাঙ্গাল মূলকেই প্রথম আলু চাষ শুরু হয়। কোলকাতা থেকে আস্তে আস্তে আলু ছড়িয়ে পরে পুরো ভারত উপমহাদেশে।
আলুর ব্যবহার
বাংলাদেশে আলু প্রধানত সবজি হিসেবে খাওয়া হয়ে থাকে। এটি অপ্রধান একটি খাদ্য। যদিও বিশ্বের বহুদেশে আলু প্রধান খাদ্য হিসেবে বিবেচিত। ইউরোপে আলুকে শুধু সবজি হিসেবে নয়, বরঞ্চ প্রক্রিয়াজাত করে নানান সুস্বাদু খাদ্য তৈরি করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে স্টার্চ, পটেটো মিল, ডেক্সট্রোজ, এলকোহল ইত্যাদি। প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে আলুর চিপস, শুষ্ক চটকানো আলু, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস এবং টিনজাত আলুও পাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার তথা আমেরিকা অঞ্চলের চেয়ে ইউরোপীয় অঞ্চলে খাবার হিসেবে অনেক বেশি পরিমাণে আলু খাওয়া হয়। জেনে নিন বিভিন্ন গাছ দিয়ে ঘর সাজানোর দুর্দান্ত আইডিয়াসমূহ।
বাংলাদেশে আলুর প্রধান ব্যবহার সবজি হলেও বর্তমানে আলু দিয়ে বৈচিত্র্যময় খাবার তৈরি করা হচ্ছে। আলু থেকে তৈরি উল্লেখযোগ্য খাদ্যসামগ্রী হচ্ছে সিদ্ধ আলু, ভাজা আলু, চটকানো আলু, আলুর রুটি, আলুর ওয়েজেস, আলুর চপ, আলু সিঙ্গারা, আলুর চিপস, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই প্রভৃতি। সম্প্রতি দেশের বেকারি ও ফাস্টফুডের দোকানগুলি আলু দিয়ে নানা রকম সুস্বাদু খাবার তৈরি শুরু করেছে।
আলুর পুষ্টিগুণ
আলুতে রয়েছে অনেক পুষ্টিমান
প্রতি ১০০ গ্রাম আলুতে রয়েছে-
শর্করা——১৯গ্রাম
আশ——-২.২ গ্রাম
প্রোটিন———-২ গ্রাম
খনিজ লবণ—.৫২ গ্রাম
ভিটামিন এ,বি,সি—-.০২ গ্রাম
বাজারে বারোমাসেই আলু কিনতে পাওয়া যায়। কিন্তু যদি তাজা ও ভেজালমুক্ত আলু চান তবে বাড়ির ছাদে কিংবা বারান্দায় আলু চাষ করতে পারবেন।
ছাদে দুই উপায়ে আলু চাষ করা যায়-
১. টব/কন্টেইনার।
২. বড় ছিদ্র যুক্ত প্লাস্টিকের ঝুড়ি।
জায়গা নির্বাচন
ক) প্রচুর আলো বাতাস চলাচল করে এমন জায়গা বেছে নিন।
খ) সকাল বিকাল রোদ পড়ে এমন জায়গা নির্ধারণ করুন। শুধুমাত্র দুপুরে রোদ পড়ে ঐমন জায়গা নির্ধারণ করবেন না।
টব/কন্টেইনারে চাষ
ক) কন্টেইনারের উচ্চতা ২-৩ ফুট এবং ধারণক্ষমতা ৪০-৫০ লিটার হতে হবে।
খ) অতিরিক্ত পানি বের হবার জন্য প্রতি কন্টেইনারের নিচে ৩/৪ ইঞ্চি ফুটো করে নিন।
গ) মাঝারি সাইজের টব বেছে নিন। এতে ১০টি চারা রোপণ করা যায়।
মাটি প্রস্তুতি ও বীজ নির্বাচন
ক) দোআঁশ,বেলে দোআঁশ মাটি বেছে নিতে হবে। মাটিতে প্রচুর পরিমাণে জৈব সার থাকতে হবে।
খ) মাটিতে পর্যাপ্ত আর্দ্রতাসহ ভালভাবে সার প্রয়োগকৃত রৌদ্রোজ্জ্বল জমি আলু লাগানোর জন্য যথোপযুক্ত।
গ) মাটিতে কমপোস্ট ব্যবহার করা অনুচিত। এতে রোগ-বালাইয়ের প্রকোপ বেড়ে যায়। এর বদলে গোবর পচিয়ে মাটিতে ভালোভাবে মিশিয়ে নেওয়া ভাল।
ঘ) ২/৩ ভাগ পরিমাণে মাটি ও সার মিশিয়ে নিন। সার হিসেবে কম্পোস্ট, ফসফেট, পটাশ নিন।
ঙ) মাটিতে সার মিশিয়ে ভালো করে ঝরঝরে করে নিতে হবে। মাটির উপর দিক সমান করে নিন।
চ) মাটি শুকনো হলে পানি দিয়ে ভিজিয়ে নিন।
ছ) বীজ/কাটিং চারা নিন। বীজ যেকোনো নার্সারিতে পাওয়া যায়।
জ) পুরানো আলু থেকে কাটিং চারা সংগ্রহ করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে আলুর অঙ্কুর গুলো ১-২ ইঞ্চি আলু সহ কিউব করে কেটে উপরমুখি রেখে দিন। ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে।
ঝ) মাটিতে ৫/৭ ইঞ্চি দূরত্বে বীজ বপন করতে হবে। মিষ্টি আলুর বীজ বপনের উপযোগী সময় হল মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য নভেম্বর।
ঞ) ৪/৫ ইঞ্চি করে মাটির মিশ্রন দিয়ে বীজের উপরিভাগ ঢেকে দিন।
ট) কচুরিপানা মাটিতে ব্যবহার করলে মাটির আদ্রর্তা বজায় থাকবে।
ঝুড়িতে চাষ
ক) একটি ছিদ্র যুক্ত ঝুড়ি ও বড় বালতি নিন যেটি ঝুড়ির থেকে বড় হবে।
খ) কোকোপিট, গোবর, কম্পোস্ট একসাথে মিশিয়ে সার তৈরি করুন।কোকোপিট ৩০%, গোবর ২০%, কম্পোস্ট ২০% হতে হবে।
গ) ঝুড়িতে আলুর বীজ বা কাটিং চারা রোপণ করে সেটি বালতিতে স্থাপন করুন।
ঘ) আলু বড় হয়ে গেলে ঝুড়িটি তুলে ফেলুন ও ছিদ্রগুলো দিয়ে আলু সংগ্রহ করে নিন।
সার প্রয়োগ
ক) টবে বা কন্টেইনারে আলু চাষে জিপসাম, টিএসপি, এমওপি, ইউরিয়ার অনুপাত ১ঃ২ঃ৩ঃ৩ হওয়া বাঞ্ছনীয়। এছাড়া সামণ্য পরিমাণের সালফেট ও বোরন সার মিশ্রিত করে দিতে হবে।
খ) জমিতে আলু চাষে জিপসাম, টিএসপি, এমওপি, ইউরিয়া যথাক্রমে ৪০ কেজি, ৭৫ কেজি, ১১২ কেজি, ১১২ কেজি করে প্রদান করতে হবে এবং জিং সালফেট ৫ কেজি ও বোরণ সার ৪ কেজি ব্যবহার করতে হবে।
গ) অর্ধেক ইউরিয়া, অর্ধেক এমওপি ও সম্পূর্ণ টিএসপি এক সাথে মিশিয়ে বীজ আলু বপনের পাশে সারের নালায় দিতে হয়।
ঘ) বাকি সার রোপণের ৩৫ থেকে ৪০ দিনের মধ্যে উপরি প্রয়োগ করতে হয়।
ঙ) আর জিপসাম, জিংক সালফেট এবং বোরন সার শেষ চাষের সময় ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়।
চ) মাটিতে ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতি থাকলে শেষ চাষের সময় ম্যাগনেশিয়াম প্রদান করতে হবে।
সেচ ও নিষ্কাশন
ক) রোপণের পর গাছের মাথা স্পষ্ট হলে সার প্রয়োগ করে হালকা সেচ দিতে হবে। মূলত রোপণের ৭ দিনের মধ্যে দিতে হবে।
খ) মাটির রসের উপস্থিতির উপর নির্ভর করে প্রয়োজনানুযায়ী ৩-৫ বার সেচ দিতে হবে।
গ) ৪০ দিন পর টিউবার গঠন হওয়া শুরু হলে অবশ্যই সেচ দিতে হবে।
টবে/কন্টেইনারে চাষের জন্যে এটিই সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি। কারণ এই মাটিতে পুনরায় আলু চাষ করা যাবে।
আলু গাছের পাতা প্রায় ১০ সপ্তাহ পর হলুদ হতে শুরু করলে আলু তুলতে হবে।
আলুকে ভাতের বিকল্প হিসেবে খাওয়া যায়। মানসিক চাপ দূর করতে আলুর জুড়ি নেই।
তাই আলু খান, সুস্থ থাকতে বাড়ির ছাদে আলুর চাষ করুন!
- জেনে নিন গোল মরিচের ১০ টি চমৎকার উপকারিতা - September 11, 2020
- মালবেরি বা তুঁত চাষ পদ্ধতি - May 23, 2020
- ছাদবাগানে আম চাষ – আম গাছের জোড় কলম পদ্ধতি - March 20, 2020