ড্রাগন সম্প্রতি বাংলাদেশের বাজারের পরিচিত হওয়া সম্ভাবনাময় বিদেশী ফল। এখন বাড়ির ছাদ বাগানে বড় টবে বা ড্রামে ড্রাগন ফল চাষ করতে পারবেন। এই নতুন স্বাদের ফলটি যেমন আপনার পুষ্টির চাহিদা মেটাবে, তেমনি বিক্রি করে আপনি করতে পারবেন অতিরিক্ত উপার্জনও। ছাদ বাগানে ড্রাগন ফল চাষ পদ্ধতি বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করা হলো।
চারা নির্বাচন
ড্রাগনের চারা বীজ থেকেই সহজে উৎপাদন করা যায়। বর্তমানে ভাল ভাল নার্সারিগুলোতে ড্রাগন গাছের চারা পাবেন। বাংলাদেশ কৃষি অধিদপ্তরও ড্রাগনের চারা বিক্রি করছে। চারা কাটিং হতে হবে। বীজ দিয়ে উৎপাদিত ড্রাগন গাছে ফল ধরতে কয়েক বছর লাগতে পারে। চারার গোড়া শক্ত এবং সুস্থ সবল, দু-তিনটি বা আরও বেশী শাখাযুক্ত হতে হবে।
উপকরণ
ক) সবল ড্রাগন গাছের চারা।
খ) ১৮-২০ ইঞ্চি টব বা কেমিক্যালের বড় ড্রাম। হাফ ড্রাম হলেও হবে ( অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের জন্যে টবের বা ড্রামের নীচে ৪-৫ টি ১-১.৫ ইঞ্চি করে একটি ছিদ্র থাকতে হবে)।
গ) উপযুক্ত গোবর সার মিশ্রিত মাটি, শুকনো গোবর, জৈব সার।
মাটি প্রস্তুত প্রণালি
গোবর সার এবং জৈব সার, ড্রাগন গাছের জন্যে অতি আবশ্যক। এক ভাগ পচা গোবর দু ভাগ মাটির সাথে মিশ্রিত করতে হবে। ড্রামের মধ্যে তিনটি স্তরে আমরা মাটি দেবো।
প্রথম স্তর
নিচের স্তরে ইট/কঙ্কর ড্রামের ছিদ্র পথে দিয়ে দিন। কিছু পরিমাণ বালি দিয়ে দিলে ভাল। এটি ফিলটারের কাজ করবে। এর পর গোবর সার মিশ্রিত মাটি প্রথম স্তর হিসেবে ড্রামের কিছু অংশ ভরাট করে ফেলুন।
দ্বিতীয় স্তর
এই স্তরে মাটর সমপরিমাণ কিছু জৈব সারসহ গোবরের একটি স্তর দিয়ে ড্রামের ৩ থেকে ৪ ইঞ্চি জায়গা ভরে ফেলুন। স্তরটি ভর্তি হলে, আবারও জৈব মিশ্রিত মাটি এর উপরের কিছু অংশে যুক্ত করুন। এই স্তরেই চারা গাছটিকে রোপণ করতে হবে।
তৃতীয় স্তর
জৈব সার ও গোবর মিশ্রিত মাটি দিয়ে চারা গাছটির রোপণ কাজ সম্পূর্ণ করুন। ড্রামটি মাটি দিয়ে পুরোপুরি ভরে ফেলবেন না। ড্রামের ১.৫-২ ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা খালি রাখবেন। নইলে পানি দিলে সেগুলো চুইয়ে চুইয়ে বেরিয়ে যাবে। চারাটি যেন বাতাসে হেলে না পরে সে ক্ষেত্রে মাঝে খুঁটি বসিয়ে শক্ত পাটের বা প্লাস্টিকের দড়ি দিয়ে খুঁটির সাথে বেঁধে রাখতে হবে। চারাটি যতটুকু লম্বা, ততটুকু লম্বাই খুঁটি ব্যবহার করতে হবে।
সেচ/পানি ব্যবস্থাপনা
ড্রাগন গাছ একেবারেই খুব বেশি পানি সহ্য করতে পারে না। গাছের গোড়া কখনোই স্যাঁতস্যাঁতে ও আর্দ্র রাখবেন না। নিয়মিত ১০ দিন অন্তর অন্তর আগাছা পরিষ্কার রাখুন। আগাছা বাড়লে রোগবালাই বেশি ছড়ায়। আর গাছ পুষ্টি হতে বঞ্চিত হয়। গাছের গোড়া আর্দ্র থাকলে পানি দিবেন না। বর্ষাকালে পানি জমার সম্ভাবনা দেখা দিলে, গাছের চারপাশ থেকে মাটি নিয়ে গাছটির গোড়া উঁচু করে দিন। যেন পানি জমে গিয়ে গাছের গোড়া ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। বর্ষা শেষে আবার আগের মত করে নিন।
গোড়া শুকিয়ে গেলেই কেবলমাত্র পানি দিতে হবে। তাই প্রতিনিয়ত খেয়াল রাখা জরুরি। কেননা ফল বা ফুল গাছে খরা দেখা দিলে, পানি দিতে দেরি হলে, এতেও ফুল/ফল ঝরে যেতে পারে।
সার ব্যবস্থাপনা
রাসায়নিক সারের ব্যবহারে নিয়ম জানা না থাকলে ব্যবহার করবেন না। ড্রাগনের চারা লাগানোর ২.৫ থেকে ৩ মাস পর জৈব সার/গোবর ব্যবহার করতে হবে। এর পর ড্রাগন গাছ ও মাটির পরিস্থিতি অনুযায়ী বছর বছর জৈব সার/গোবর প্রয়োগ করবেন। তবে অবশ্যই, বর্ষার মৌসুমের পূর্বে একবার এবং বর্ষার শেষে আরেকবার এই জৈব সার এবং গোবর ব্যবহার করা শ্রেয়। গাছের মাটি শুকনো থাকা অবস্থায়, ভাল করে মাটি ঝুরঝুরে করে, মাটির সাথে সার মিশিয়ে দিতে হবে। এরপর পানি দিবেন। ড্রাগন গাছ লাগানোর ৪ মাস পর হতে, প্রতি মাসে একবার খৈল পচা পানি ব্যবহার করবেন। পানির সাথে মিশিয়ে খৈলটি ৩-৪ দিন পচিয়ে নিতে হবে, সেই পানির সাথে অতিরিক্ত পানি যুক্ত করে পানিটি একেবারে পাতলা করে ফেলতে হবে। এরপর সেই পানিটি ব্যবহার করতে হয়। খৈলের পানি দেওয়ার আগে আগে গাছে পানি দিবেন না। পরদিন পানিটি ব্যবহারের পূর্বে গাছের মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। টব বা কন্টেইনারের আকারের ভিত্তিতে সেই পানি ব্যবহার করতে হবে। ড্রাম হলে বড় মগের এক থেকে দেড় মগ ব্যবহার করুন। আর ড্রাম বা টবের সাইজ যত কম সে অনুপাতে এই পানিটি কম পরিমাণে দিতে হবে। ১৬ বা ১৮ ইঞ্চির টবে এক মগের অল্পই যথেষ্ট। এ ছাড়া হাড়ের গুড়ো ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে টব এবং ড্রামের সাইজ ভিত্তিতে হাড়ের গুড়ো খুব অল্পই ব্যবহার করা যেতে পারে। ৬ ইঞ্চি টবের মাটিতে আধা মুঠোর চেয়েও কম। ১২ ইঞ্চি টবের মাটিতে এক মুঠো এবং হাফ ড্রামে ৪-৫ মুঠোর বেশী ব্যাবহার করবেন না। যে কোন সার ব্যবহারের পূর্বে, গাছের মাটি নিড়িয়ে ঝুরঝুরে করে মাটির সাথে সার মিশিয়ে দিয়ে পানি দিবেন। গাছ লাগানোর সাথে সাথেই অন্যান্য সার ব্যাবহার করা যাবে না। তাকে মাটি এবং আবহাওয়ার সাথে আগে উপযুক্ত হতে দিন। লাগানোর ২.৫-৩ মাস পর আমরা জৈব সার/গোবর ব্যাবহার করবো, খৈলের পানি, অন্যান্য সার দরকার প্রয়োজন ভিত্তিতে ব্যবহার ও প্রয়োগ করবো।
আরও পড়ুনঃ ড্রাগন ফল পরিচিতি
ড্রাগন গাছে টায়ার ব্যবস্থাপনা
ড্রাগন গাছ লতানো ইউফোরবিয়া গোত্রের ক্যাকটাসের মতো, তাই কখনও কখনও বাড়তি এই ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন পড়বে। গাছ বেড়ে উঠতে শুরু করলেই যথাসম্ভব রিক্সা/গাড়ির টায়ার, ৪-৫ টি মজবুত শক্ত বড় বড় খুঁটি/বাঁশ, নাইলনের দড়ির ব্যবস্থা করুন। এরপর গাছটির পাশে শক্ত করে কয়েকটি খুঁটি বসিয়ে, গাছটির শাখা চারপাশে খুঁটির সাথে বাঁধুন। খুঁটি/বাশের উপর দিয়ে একটা ছিদ্র করে তাতে লোহার গুণার সাহায্যে টায়ার যুক্ত করুন এবং তার সাথে টায়ারটি ভাল করে বেঁধে ফেলুন। এরপর উপরে ছড়িয়ে থাকা ড্রাগনের ডাল ও শাখাসমূহ টায়ারের উপর দিয়ে ছেড়ে দিন। খেয়াল রাখতে হবে টায়ারটি গাছের শাখা প্রশাখার ভার বহন করছে কিনা। এজন্যে ভাল মজবুত টায়ার এবং খুঁটি/বাঁশ প্রয়োজন।
ছাদে যদি কোন পাশে পিলার থাকে তবে পিলারের সাথেই ড্রাগন গাছের চারিপাশের শাখাগুলো বেঁধে দিন। সাধারণত এই পিলার জমিতে ড্রাগন চাষে ব্যবহার করা হয়।
ফলন
ভাল পরিচর্যা পেলে ৭-৮ মাসেই ড্রাগনে ফল ধরা শুরু করে। ড্রাগন ফলের কাটিং চারা রোপনের ১২ থেকে ১৮ মাস বয়সে ফল সংগ্রহ করা যায়। গাছে ফুল ফোঁটার মাত্র ৩৫-৪০ দিনের মধ্যেই ফল খাওয়ার উপযুক্ত হয়।
ছাঁটাই
ড্রাগন ফলগাছ তাড়াতাড়ি বাড়ে। ফলন শেষে, শাখা প্রশাখা ভাল করে ছেঁটে দিতে হবে। ছেঁটে দেওয়ার পর পরই ভাল ছত্রাকনাশক ব্যাবহার করতে হবে। ছাদের প্রত্যেকটি ফল গাছই ফলনের পর ছাঁটাই করা জরুরী। এতে করে রোগ আক্রান্ত ডালপালা কমে যাবে। সামনে আরও ইনশা’আল্লাহ্ বেশী ফলন আশা করা যাবে। আর গাছটির গঠন মজবুত ও সুন্দর হবে, গাছটি মাটি হতে খাদ্য উপাদান সুন্দর ভাবে গ্রহন করতে পারবে।
পরিশেষে
ক) একটি ড্রাগন গাছ প্রায় পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত জীবিত থাকতে পারে।
খ) আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে মে থেকে অক্টোবর মাসে ফল সংগ্রহ করা যায়। শীতকালে ড্রাগন গাছ ফুল দেয়া বন্ধ করে দেয়। ড্রাগন ফল পাকা অবস্থায় ৫ থেকে ৭ দিন গাছে রেখে দেওয়া যায়। আর গাছ থেকে ফল সংগ্রহের পর রাখা যায় প্রায় এক মাস।
গ) বর্তমানে বাংলাদেশের রংপুর, রাজবাড়ি , নাটোর, রাঙামাটিসহ বিভিন্ন স্থানে ড্রাগন ফলের চাষ করা হচ্ছে। ঢাকার কিছু অভিজাত হোটেল এই ফল প্রতি কেজি তিনশ থেকে চারশ টাকায় বিক্রি করছে।
- খোলা লোমকূপজনিত সমস্যা সমাধানে দৈনন্দিন সবজি - May 4, 2020
- মানসিক ও শারীরিক সুস্থতায় বাগানের কার্যকারিতা - April 22, 2020
- বাসা-বাড়ি পরিষ্কার এবং জীবাণুমুক্ত রাখার উপায় - April 12, 2020