বাগানীদের জন্যে গাছের রোগ-বালাই খুবই চিন্তার বিষয়। এমনই কিছু রোগ বালাইয়ের পরিচিতি ও রোগ-বালাই সম্বন্ধে জানানোর ধারাবাহিক আয়োজনে আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব। এই পর্বে আমরা ক্যানকার, সাডেন ডেথ, পাউডারি মিলডিউ, মরিচা বা রাস্ট, শুটি মোল্ড ও ক্লাব রুট ইত্যাদি ছত্রাকজাতীয় রোগ সম্বন্ধে জনব। এর আগে পড়ে নিতে পারেন বাগানের মারাত্মক কিছু রোগ ও এর প্রতিকার – প্রথম পর্ব টি।
নেক্ট্রিয়া ক্যানকার (Nectria Cankers)
এই রোগটি বেশিরভাগ বৃক্ষজাতীয় গাছে এবং কিছু লতা বা গুল্মগুলিতে হতে পারে। উদ্ভিদের ডুবে যাওয়া অংশ কিংবা ক্ষতস্থানগুলির কাছাকাছি জায়গায় মাঝে মাঝে গাড় বাদামী ছত্রাক দেখা দেয়। সুড়ঙ্গকারী পোকার আক্রমণে এই ছত্রাকের আবৃভাব হয়ে থাকে। এর ফলে শাখা বা পাতা মরে যেতে পারে এবং অল্প বয়স্ক গাছগুলি বেঁকে যেতে পারে। এই জাতীয় ক্যানকারে খুব কমই গাছই মারা যায়। রোগ দমনের জন্যে, ক্যানকার আক্রান্ত অংশের কয়েক ইঞ্চি নিচে থেকে গাছের শাখাগুলি কেটে ফেলুন। রোগ ছড়িয়ে পড়া এড়াতে যে সরঞ্জাম দিয়ে কাটবেন, হতে পারে কোনো প্রুণিং ছুড়ি, সেটি অ্যালকোহল দিয়ে জীবাণুমুক্ত করে নিন। পোকা দমনের জন্য সুমিথিয়ন বা ফলিথিয়ন ২০ মিলিলিটার অথবা ক্লোরপাইরিফস জাতীয় কীটনাশক ১০ লিটার পানিতে ১০ দিন পরপর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করুন। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
সাডেন ওক ডেথ (Sudden Oak Death)
এটি Phytophthora ramorum নামক ফাঙ্গাসের কারণে হয়ে থাকে। এই রোগটি প্রথম ১৯৯০ সালে শণাক্ত করা হয়। এই রোগের ফলে ওক জাতীয় গাছ অল্প কয়দিনের মধ্যেই মরে যায়। এই রোগটি ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটি প্রধাণত কেবল পশ্চিম আমেরিকার ওক পরিবারের গাছগুলোকেই আক্রান্ত করে, পরবর্তীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও এটি অন্যান্য কিছু প্রজাতির উদ্ভিদেও ছড়াতে পারে। অন্যান্য উদ্ভিদে বেশিরভাগ সময় শাখা এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে পাতায় এই রোগের উপসর্গগুলো দেখা যায়। আক্রান্ত অংশ ছাঁটাই করে রোগটি ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব। কিন্তু ওক জাতীয় গাছে এটি সমস্ত অংশকেই প্রভাবিত করতে পারে এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, ফলে গাছের মৃত্যু হয়। রোগাক্রান্ত অংশ অপসারণ এবং ধ্বংস করে ফেলাই একমাত্র চিকিত্সা, এবং এর ছড়িয়ে পড়া রোধেও কার্যকরী ভুমিকা রাখে।
![বাগানের মারাত্মক কিছু রোগ ও এর প্রতিকার - দ্বিতীয় পর্ব 2 Cankers - Garden Diseases](https://www.fix.com/assets/content/30476/cankers.png)
Source: Fix.com Blog
পাউডারি মিলডিউ (Powdery Mildew)
বাগানীদের মধ্যে এই রোগটিকে চেনে না, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া ভার। একধরণের সাদা পোকা, যার সারা শরীরে সাদা গুড়ো গুড়ো লেগে থাকে। ছাদবাগানে এই রোগের প্রাদুর্ভাব প্রবল। এরা কান্ড, পাতা সমস্ত অংশে ছড়িয়ে পড়ে। পাতা ও গাছের গায়ে সাদা পাউডারের মত দাগ হিসেবে আবির্ভূত হয়, ধীরে ধীরে সমস্ত পাতায় ছড়িয়ে পড়ে। বেশি আক্রান্ত পাতা হলুদ বা কালো হয়ে মারা যায়। এই রোগের আক্রমণ প্রতিহত করতে নিম তেলের মতো ছত্রাকজনিত স্প্রে ব্যবহার করুন এবং আক্রান্ত পাতা ও কাণ্ড ছাঁটাই করে ধ্বংস করুন, যেন ছড়িয়ে না পড়ে। রাসায়নিক ছত্রাকনাশক হিসেবে কুমুলাস ৪০ গ্রাম বা গেইভেট বা মনোভিট ২০ গ্রাম অথবা কার্বেন্ডাজিম জাতীয় ছত্রাকনাশক গোল্ডাজিম ৫ মিলি বা এমকোজিম বা কমপ্যানিয়ন ২০ গ্রাম প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে দশ দিন পরপর মোট ২ থেকে ৩ বার প্রয়োগ করুন। গাছের প্রতিরোধের ব্যবস্থা জোরদার করতে মালচিং করুন নিয়মিত।
মরিচা (Rust)
এই রোগের কারণে পাতার পিছনে বাদামি বা হলুদ বর্ণের নোড বা ফুসকুড়ি দেখা যায়। এগুলো পাতার শিরার সমান্তরালে অবস্থান নিতে দেখা দেয়। বৃদ্ধি পেতে পেতে একসময় ফুসকুড়িগুলো পুরো পাতাকে আক্রান্ত করে ফেলে। কখনো কখনো গাছের কান্ড ও শীর্ষেও এই ছত্রাক আক্রমণ করতে পারে। মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়লে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং উদ্ভিদের ফলন হ্রাস পায়। রোগাক্রান্ত গাছ ছাঁটাই এবং ছড়িয়ে পড়া এড়াতে ধ্বংস করে ফেলুন। এছাড়া Bacilus Pumilus নামক জৈব নাশক ৭-১৪ দিন অন্তর অন্তর আক্রান্ত অংশে প্রয়োগ করা যেতে পারে। বীজতলা তৈরির সময় হেক্টরপ্রতি ২ টন ট্রাইকোকম্পোস্ট ব্যবহার করতে পারেন। আকোনাজল বা ক্রিজল ১ মিলি বা টিল্ট ২৫০ ইসি (০.০৪%) ১ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার করে স্প্রে করতে হবে ।
![বাগানের মারাত্মক কিছু রোগ ও এর প্রতিকার - দ্বিতীয় পর্ব 3 Common Diseases - Garden Diseases](https://www.fix.com/assets/content/30476/other-common-diseases.png)
Source: Fix.com Blog
শুটি মোল্ড (Sooty Mold)
এই কালো মোল্ডজাতীয় ছত্রাকটি গাছের রস চোষক পোকামাকড় যেমন সাদা মাছি ও স্কেল পোকার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ অংশের চারপাশে দেখা যায় এবং প্রায়শই চিরসবুজ গুল্মজাতীয় উদ্ভিদে এর আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। বাড়ন্ত ও পূর্ণ বয়স্ক গাছের পাতা ও কান্ডে এই মোল্ড দেখা যায়। কীটগুলিকে যতদ্রুতসম্ভব ধ্বংস করে ফেলুন এবং মোল্ডগুলি ঘষে ঘষে পাতা থেকে দূর করুন। প্রয়োজনে ছাঁটাই করুন। পোকা দমনের জন্য সুমিথিয়ন বা ফলিথিয়ন ২০ মিলিলিটার প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার ভালভাবে স্প্রে করুন এবং ছত্রাক দমনে প্রপিকোনাজল জাতীয় বালাইনাশক টিল্ট ২৫০ ইসি ৫ মিলি প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার ভালভাবে স্প্রে করুন।
ক্লাব রুট (Club Root)
এটি একধরণের আঠালো মোল্ড এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্রাসিকাস পরিবারের অন্তর্ভূক্ত উদ্ভিদ যেমন ফুলকপি, বাধা কপি, শালগম, মূলা, ব্রোকলি, ব্রাসেলস স্প্রাউট ইত্যাদি আক্রান্ত হয়ে থাকে। তবে মূলার বর্ধণশীলতার কারণে এটি মূলার জন্যে তেমন একটা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। Plasmodiphora Brassicae জাতীয় ছত্রাকের কারণে এই রোগটি হয়ে থাকে। সংক্রামিত মাটিই এই রোগটি ছড়ানোর প্রধান কারণ।
তবে এটি ব্রাসিকা গোত্রভুক্ত উদ্ভিদের জন্যে সাধারণ কোনো রোগ নয়। তবে এটি যদি একবার হয়ে যায়, তবে ১০ বছর পর্যন্ত মাটিতে বেঁচে থাকতে পারে। প্রতিরোধের জন্য বছর বছর আপনার বাগানে ফসল রোটেশন করুন এবং আক্রান্ত মাটিতে কয়েক বছর ব্রাসিকা জাতীয় সবজিগুলো না লাগানোই ভাল।
- বাংলাদেশে পঙ্গপাল আক্রমণের সম্ভাবনা - July 10, 2020
- রকমেলন চাষ ও এর পরিচর্যা - July 6, 2020
- ঘরোয়া উদ্ভিদের রোগ-বালাই নিয়ন্ত্রণ – দ্বিতীয় পর্ব - July 3, 2020