Skip to content

ভাদ্র মাসের কৃষি

আকাশের মন খারাপের পালা যে শেষ। এবার হাসবে আকাশ উচ্ছ্বাসে পড়বে ফেটে। কখনো পরিষ্কার নীল আকাশ, কখনো বা মেঘের ভেলা দিক বেদিক ছুটে চলা। ভাদ্র ও আশ্বিন মিলে শরৎকাল। ভোরবেলার পথিক পায়ে ছুয়ে যাওয়া ঘাসের ডগায় শিশির জমে। শরতের শেষে রোদের তেজ আস্তে আস্তে কমতে থাকে। শরৎকালে শিউলি ফুলের সুবাস মেখে চারিপাশ, সন্ধ্যেয় কামিনীর উপস্থিতি জানান দেয় পথচারীকে।  গোলাপের নজরকাড়া রঙ, বকুল ফুলের মালা গলায় নিয়ে কিশোরী যেন মল্লিকা সুন্দরী সাজে। মাধবীলতা  দালান বেয়ে উঠে গেছে পরিচিত-অপরিচিতের। বিলে-ঝিলে ফোটে শাপলা আর নদীর ধারে কাশফুল। সঙ্গী যুবতীর। ভাদ্রের শেষ গরমে গাছে তাল পাকে। পিঠা-মন্ডায় হিন্দু ধর্মাবলন্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার প্রসাদ পসরার আয়োজন।

বর্ষার পরেই আসে শরৎকাল। শরতের প্রথম মাস ভাদ্র মাসের চাষাবাদ নিয়ে শুরু করছি আজকের আলোচনা।

শাকসবজি

  • শাকসবজি চাষের জন্য প্রথম ও প্রধান কাজগুলোর একটি হলো কোন স্থানে কোন সবজির চাষ হবে ও তার জন্য উপযুক্ত মাটি তৈরি। ২ভাগ জৈব সার (গোবর/ কম্পোস্ট/ ভার্মি কম্পোস্ট), ১ ভাগ কোকোডাস্ট ও ১ ভাগ  উর্বর দোআঁশ মাটি মিশিয়ে চারার উপযোগী মাটি তৈরি করে নিতে হবে। মাটি বেশ মিহি, ঝুরঝুরে ও সমতল ভাবে তৈরি করতে হবে। পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা থাকবে। পর্যাপ্ত জৈব সারের পাশাপাশি পরিমিত মাত্রায় রাসায়নিক সার দিতে পারেন।
  • সবজি চারা উৎপাদনের জন্য উঁচু এবং আলো বাতাস লাগে এমন জায়গা নির্বাচন করতে হবে।
  • এক মিটার চওড়া এবং জমির দৈর্ঘ্য অনুসারে লম্বা করে বীজতলা তৈরি করতে পারেন। অথবা প্যাকেটে/ ছোট টবে/ সীডলিংট্রে(seedling tray)তে এগুলোতে বীজ থেকে চারা তৈরি করে নিতে পারেন।
  • আগাম রবি (শীতকালীন) সবজি যেমন- বাঁধাকপি, ফুলকপি, লাউ, শিম, টমেটো, বেগুন এর উন্নত জাতের বীজ বুনতে পারেন।
  • বারি স্কোয়াশ-১  আগাম শীতকালীন ফসলের জন্য ভাদ্র মাসের ১ম সপ্তাহ থেকে বীজ বপন করতে পারেন।
  • ছাদবাগানে ড্রাম বা টবে বা বেডে ভালোভাবে মাটি তৈরি করে সরাসরি বীজ বপন করে লালশাক,  পালংশাক, পুইশাক চাষ করতে পারেন। 
  • লাউ, স্কোয়াশ ও শিমের বীজ বপনের জন্য ৭৫ সেমি. চওড়া এবং ৬০ সেমি. গভীর টব বা ড্রাম বা বেড ভালো হয়।
  • লাউ ও শিমের জন্য- বেড/ টব / কাটা ড্রামের অর্ধেক সমআয়তন মাটির সাথে ১ বছরের পুরোনো শুকনো পচা গোবর সার এবং তার সাথে ১০০-১৫০ গ্রাম টিএসপি এবং ৫০-৭০ গ্রাম এমওপি সার মিশিয়ে মাটি তৈরি করে নিবেন। ৭-১০দিন পর মাটি উলোটপালোট করে তারপর প্রতি বেডে/ ড্রামে/ টবে ৪-৫টি সবল বীজ বপন করবেন। চারা গজানোর ১৫-২০দিন পর ২ বার করে ১০০-১৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০-৭০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করবেন। যারা একদমই রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে চান না তারা চাইলে শুধু জৈবসার দিতে পারেন।    
  • নার্সারি থেকে ৩০-৩৫ দিন বয়সী সুস্থ সবল চারা মাদা/ বেড/ ড্রামে/টবে রোপণ করতে হবে।
  • বেশি ঘন করে চারা লাগালে তা আলো, বাতাস, পানি ও মাটিস্থ পুষ্টি গ্রহণের প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয় তাই প্রত্যেকটি চারা সমনির্দিষ্ট দূরত্বে লাগাতে হবে।
  • লাউ ও শিম, লতানো সবজি , চারা লাগানোর পর গাছগুলো বড় হতে থাকলে মাচা তৈরি করে দিবেন।
  • লতানো সবজির দৈহিক বৃদ্ধি তথা- কান্ড, পাতা, শাখা-প্রশাখা যত বেশি হয় , তার ফুল ফল ধারণ ক্ষমতা তত কমে হয়। তাই ১৫-২০% লতা-পাতা কেটে দিতে হবে। তাহলে, গাছে দ্রুত ফুল ও ফল ধরবে।
  • কুমড়া গোত্রের সবজি লাউয়ের শত ভাগ পরাগায়ন ও অধিক ফলন নিশ্চিত করতে, হাত-পরাগায়ন অপরিহার্য। গাছে ফুল ধরা শুরু হলে প্রতিদিন ভোরবেলা হাতপরাগায়ন নিশ্চিত করলে ফলন অনেক বেড়ে যাবে।

বিনাটমেটো-৬ চারা রোপন করতে পারেন। টমেটো চাষে পলিথিনের ছাওনির ব্যবস্থা করার পাশাপাশি ১ লিটার পানিতে ২০ মিলি টমেটোটোন নামক হরমোন মিশিয়ে ফুল আসার পর ফুলের গায়ে ৫-৭ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করলে অধিক ফলন নিশ্চিত।

  • পূর্ববর্তী মাসেরসবজি ফসল ফসল উঠানো বা সংগ্রহ করার পর বীজ সংরক্ষণ করতে পারেন।
  • এ সময় ঝড় বৃষ্টি কম হওয়ায় মরিচ চাষের উপযোগি সময়। সুতরাং বারোমাসি জাতের পাশাপাশি  বিভিন্ন জাতের মরিচ চাষ শুরু করে দিতে পারেন।
  • চৈত্র মাসের শেষ ও বৈশাখ মাসের শুরুতে যারা হলুদ লাগিয়েছেন তারা এখন ফসল তুলতে পারেন।

পরিচর্যা

  • চারাকে ভাইরাস বা ব্যক্টেরিয়া কিংবা ছত্রাকজনিত রোগ থেকে রক্ষার জন্য চারা লাগানোর আগেই মাটি শোধন করতে পারেন।
  • চারা গজানোর পর ‘গোড়া পচা’ রোগ দেখা দিলে বীজতলায় পানির পরিমাণ কমাতে হবে। দ্রুত পানি নিষ্কাশন করা বা শুকনো বালি বা ছাই ছিটিয়ে দিয়ে আর্দ্রতা অর্থাৎ পানির পরিমাণ কমানো যেতে পারে। একই সাথে ডাইথেন এম-৪৫ অথবা কপার অক্সিক্লোরাইড প্রয়োগ করে রোগের বৃদ্ধি রোধ করা যায়।
  • যারা বেডে বা ড্রামে সবুজ সার ব্যবহার করেন তারা মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে, মাটিতে মেশানোর ৭/১০ দিন পর চারা রোপণ করতে পারেন।
  • সবজি ফসল ২-৩ দিনের বেশি সময়ের জন্য জলাবদ্ধতা মোটেই সহ্য করতে পারে না। তাই অধিক বৃষ্টিপাতের কারণে গাছের গোড়ার পানি নিয়মিত নিষ্কাশন করতে হবে।
  • এ মাসে তাপমাত্রা আবার বৃদ্ধি পায়, আর্দ্রতাও সর্বোচ্চে পৌঁছে যায়। তাই গাছের গোড়ায় প্রচুর আগাছা জন্মায়। এজন্য আগাছা নিড়িতে হবে। তারপর গাছে সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছের গোঁড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে। সঠিকভাবে আগাছা ব্যবস্থাপনা কৌশল জানা থাকলে ফলন অনেকাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব। জৈব উপায়ে আগাছা নির্মুল করা যায়। আর আগাছানাশকের সঠিক মাত্রা বিধি মেনে প্রয়োগ করতে হবে।
  • এ মৌসুমে শুষ্ক সময়ে প্রখর রোদব্যতীত ভোরে অথবা সন্ধ্যায় গাছে পানি এবং কীটনাশক প্রয়োগ করা উচিত। 

ফলদ গাছ, ফুল ও অন্যান্য

  • ভাদ্র মাস গাছ লাগানোর জন্য সর্বশেষ উৎকৃষ্ট সময়। সুতরাং এখনো যারা পরিকল্পনা করছেন কিন্তু গাছ লাগান নি, তারা দ্রুত বাগান তৈরির কাজে নেমে পড়ুন।
  • নানান জাতের পছন্দসই ফলদ বৃক্ষ এবং ঔষধি গাছের চারা রোপণ করতে পারেন।
  • বন্যায় বা বৃষ্টিতে মৌসুমের রোপিত চারা নষ্ট হয়ে থাকলে সেখানে নতুন চারা লাগিয়ে শূন্যস্থানগুলো পূরণ করতে হবে।
  • পানি সহনশীল- খাটো নারিকেল, পেয়ারা, সফেদা, আমড়া, কুল, ডেউয়া, শরিফা ইত্যাদি ফলের পরিকল্পিত বাগান তৈরি করতে পারেন।
  • বিভিন্ন জাতের পান, মসলার চারা বা কলম রোপণ করতে পারেন। 
  • বাগানে মশার উপদ্রব রোধে তুলসি, পুদিনা, লেমন গ্রাস, ল্যাভেন্ডার ও গাঁদাজাতীয় গাছ রাখতে পারেন। গবেষণায় দেখা গেছে, সাইপারমেথিরিন ও ম্যালাথিওন জাতীয় সক্রিয় যৌগ মশার ডিম নষ্ট করে, লার্ভা মেরে ফেলতে কাজ করে। এসকল যৌগের সাধারণত দুইটি ধর্ম থাকে- শারীরিক ও রাসায়নিক ধর্ম। উল্লিখিত গাছের পাতার বা ফুলের তীব্র গন্ধ এর শারীরিক ধর্ম; গন্ধ থাকার পাশাপাশি কীট প্রতিরোধক যৌগের সক্রিয় উপস্থিতি তথা রাসায়নিক ধর্ম থাকে এসব গাছ থাকলে মশা থাকে না। বড় ড্রাম/ টবে চাষকৃত গাছের সাথে এসব গাছ চাষ করতে পারবেন।
  • শরতের ফুল: শাপলা,শালুক,পদ্ম, জুঁই, কেয়া, কাশফুল,শিউলি জবা, কামিনী, মালতি,মল্লিকা, মাধবি, ছাতিম ফুল, ব্ড়ই ফুল, দোলনচাঁপা, বেলি জারুল, কামিনি, নয়নতারা, ধুতরা, ঝিঙে, জয়ন্ত্রী, শ্বেতকাঞ্চন, রাধাচূড়া, স্থল পদ্মা, বোগেনভেলিয়াসহ নানা রকমের কত ফুল গাছের যত্ন নেয়া।
  • বাগানের চারিতে বা ছোট জলাশয়ে জলজ উদ্ভিদ-  শাপলা, শালুক, পদ্ম ইত্যাদি চাষের করেন যারা, পানিতে কিছু গাপ্পি মাছ ছেড়ে দিলে দেখবেন মশার উপদ্রব কমে যাবে। গাপ্পি মাছ মশার ডিম, লার্ভা খেয়ে   দূরে থাকবে। গ্রাম বা মফেসসল বসবাস করছেন যারা, আপনারা বাগানে কিছু ব্যাঙ ছেড়ে দিলেও দেখবেন মশার উপদ্রব আর থাকবে না।   
  • বাগানে যেন পানি জমে না থাকে সে জন্য পরিষ্কার রাখবেন।
  • যারা টবে বা ড্রামে চাষ করছেন, আপনারা গাছের ফুল ফোঁটা শেষে বীজ সংগ্রহ করে রেখে দিতে পারেন। বৃক্ষ ও গুল্ম জাতীয় গাছের ডালপালা ছেটে সাথে সাথে খাবার দিবেন। পরবর্তীতে বাগান হয়ে উঠবে সুসজ্জিত আরও অপরূপ শোভাময়।

পরিচর্যা

  • বর্ষায় বাগানের কোথায় কোনো গাছ ক্ষতিগ্রস্থ হলে যত্ন নিতে ভুলবেন না।   
  • চারা যেন সোজা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে সেজন্য খুঁটি দিয়ে চারা বেঁধে দিবেন।
  • গৃহপালিত পশু যেমন গরু ছাগল, ভেড়া চারার পাতা যেন না খায় বা তাদের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য চারার চারপাশে খাঁচা/বেড়া ঘিরে দিবেন। 
  • ফলন্ত গাছ লেবু, পেয়ারা, কাঁঠাল, আম, নারিকেল, তাল,কলা, কমলা, আনারস, বাতাবি লেবু, মাল্টা কুল ইত্যাদি গাছের গোড়ায় মাটি উচু করে দিতে হবে। তাহলে গাছের গোঁড়ায় পানি জমে গোড়া পচে যাওয়া রোধ করবে।
  • নাবী জাতের ফল সংগ্রহ শেষে ফলের বোঁটা, গাছের ছোট ডালপালা, রোগাক্রান্ত অংশ ছেটে ‍দিলে পরের বছর বেশি করে ফল ধরে এবং গাছে রোগও কম হয়। ডালপালা কাটাই-ছাটাই করে মাটির অবস্থা বুঝে সার দিবেন।
  • আগাছা তুলে ফেলে তারপর সার প্রয়োগ করতে হবে।
  • মাসের শেষের দিকে আশ্বিন মাসের চাষের জন্য মাটি প্রস্তুত করে নিতে হবে, বীজ থেকে চারা তৈরির সময় ঘন ও দুর্বল চারা তুলে ফেলতে হবে।

গাছপালার রোগ ও পোকামাকড়

  • সবজিতে ফল ছিদ্রকারী পোকা, এফিড বা জাব পোকা, বিভিন্ন বিটল পোকা সবুজ পাতা খেয়ে ফেলতে পারে। তাই এদের দমন করার জন্য 
    • হাত বাছাই অবলম্বন করতে পারেন।
    • পোকা ধরার ফাঁদ ব্যবহার করতে পারেন।
    • ছাইগুঁড়া ব্যবহার করতে পারেন।
    • জৈব কীটনাশক ব্যবহার করতে পারেন।।
  • গাছের কাঁটা অংশে ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হবে।
  • ডেঙ্গু মশা রোধে বাগান পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বাগানের কোনোস্থানে পানি জমতে দেয়া যাবে না। জৈব উপায়ে মশা মাছি রোধ করা ভালো।
  • বিছাপোকা এবং লেদাপোকা আক্রমণ করে থাকে। এরা দলবদ্ধভাবে পাতা ও ডগা খেয়ে অনেক ক্ষতি করে থাকে। এদের আক্রমন রোধ করতে 
  • পোকার ডিমের গাদা, পাতার নিচ থেকে পোকা সংগ্রহ করে মেরে ফেলতে হবে বা পুরিয়ে ফেলতে হবে।
  • বাসার আশপাশ ফাকা থাকলে অর্থ্যাৎ গাছপালা কম থাকলে, পাখির আনাগোনা কম দেখা যায়। পাখি বসার জন্য একটা আসন তৈরি করে দিলেন। তাহলে দেখবেন পোকা খাদক পাখি যেমন শালিক, ফিঙ্গে ইত্যাদি পাখি বাগানের ক্ষতিকর পোকা খেয়ে আপনার বাগান সুরক্ষিত রাখবে।
  • পোকার আক্রমণ খুব বেশি হলে ফাইটার ২.৫ ইসি/ নাইট্রো ৫০৫ ইসি ১মিলি/লিটার মাত্রায় সঠিক সময়ে প্রয়োগ করতে হবে।

বিশেষ কিছু 

  • আগাছা পরিচিতি, বিস্তার; আগাছানাশক ও তার ব্যবহার সম্পর্কে জানতে হবে।
  • ডেঙ্গু মশা নিধনে সচেষ্ট থাকতে হবে।
  • খরিফ-২ সবজির সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও খরিফ-১ এর সবজি বীজ সংরক্ষণ।

Imtiaj Alam Rimo
Follow Me

Leave a Reply