প্যাশন ফল একটি স্বল্প পরিচিত প্রবর্তনযোগ্য ফল। বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে এই ফলের বেশ কিছু গাছ থাকলেও এখনো এদেশের মানুষের কাছে এখনো এটি অপরিচিত একটি ফল। এটিকে অনেকে ট্যাং ফলও বলে থাকে। খুব সুস্বাদু ও ভিটামিন সি সমৃদ্ধ এই ফলটির উৎপত্তিস্থান সুদূর ব্রাজিলে। হাওয়াই, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, কেনিয়ায় একে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়।
প্যাশন ফল ঝুমকো লতার নিকটাত্মীয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Parsiflora edulis sims. এটি দুটি গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। প্রথমোক্ত গোত্রের ফল বেগুনী ও অপর গোত্রের ফল হলুদ। বেগুনী ফল থেকে মিউটেশনের মাধ্যমে হলুদ ফলের উদ্ভব।
প্যাশন ফলের গাছ দীর্ঘপ্রসারী কাষ্ঠল লতা, পাতা ১০-১৫x১২-১৫ সেন্টিমিটার। বৃহদাকার ফুল বেশ সুগন্ধযুক্ত ও পাতার কক্ষে উৎপন্ন হয়, ফল গোলাকার ও মসৃণ, ব্যাসে ৪-৮ সেন্টিমিটার, হলুদ জাতের ফল বেগুনী জাত অপেক্ষা বেশ বড়।
প্যাশন ফলের ভেতরের গাত্রে হলুদাভ রসপূর্ণ থলে থাকে, এগুলিই ভক্ষণযোগ্য অংশ। একটি ৬০ গ্রাম ফল থেকে ৩০ গ্রাম রস পাওয়া যায়। এর বীজকে আবৃত করে থাকা হলুদ, জিলাটিনাস, সুগন্ধিযুক্ত পাল্পকে পানিতে মিশিয়ে খুবই সুস্বাদু রস তৈরি করা যায়। এটিকে অন্যান্য জুসের সাথেও মিশ্রিত করে খাওয়া যায়। পাল্পকে প্রক্রিয়াজাতকরণ করে আইসক্রীম, জুস, স্কোয়াশ, জ্যাম ও জেলি প্রস্তত করা যায়। বীজ ও খোসা হতে পেকটিন ও উচ্চ মাত্রার লিনোলিক এসিড সমৃদ্ধ তেল আহরণ করা সম্ভব।
প্যাশন ফলের উপাদান
ফলের মোট ওজনের ৩০-৪০% রস। রসে ৮৫% পানি, ০.৫% আমিষ, ১৩.৫% শ্বেতসার, ০.১৫% স্নেহ, ৩.৪% এসিড আছে। এসিডের ৮৫ ভাগ সাইট্রিক ও বাকিটা ম্যালিক এসিড। রসের প্রতি ১০০ গ্রামে ৫২ ক্যালোরি, ৭০০-২০০০ এ ইউ ক্যারোটিন, ২০-৩০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি, ৩.৭ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম ও ০.৩ মিলিগ্রাম লৌহ বিদ্যমান।
আরও পড়ুনঃ এভোক্যাডো চাষের সম্ভাবনা
জলবায়ু ও মাটি
প্যাশন ফলকে উপ-নিরক্ষীয় ফল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যদিও নিরক্ষীয় অঞ্চলে এর চাষও ব্যাপকভাবে হচ্ছে। অতিরিক্ত গরম বা অতিরিক্ত ঠান্ডা কোনোটাই এই ফলের জন্যে ভাল নয়। উপযুক্ত তাপমাত্রা হচ্ছে ১৮-৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বৃষ্টিপাত ফুলের পরাগায়নে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। হলুদ জাত উষ্ণতার প্রতি অধিক সহনশীল। তাই বাংলাদেশের মতো উষ্ণ অঞ্চলে এটি চাষযোগ্য। যেকোনো ধরণের সুনিষ্কাশনযোগ্য মাটিতে প্যাশন ফল চাষ করা যায়।
প্যাশন ফলের জাত
বাংলাদেশে প্যাশন ফলের মধ্যে সর্বাধিক চাষ হয় বারি প্যাশন ফল-১। এটি আকারে ৬.৮ সেমি x ৬.৩ সেমি। ফসলের গড় ওজন ৬৮ গ্রাম এবং ৩০ গ্রাম রস পাওয়া যায়।
বংশবিস্তার
বীজ ও শাখা কলম দিয়ে প্যাশন ফলের বংশবিস্তার করা হয়। চারা রোপণের পদ্ধতি ও দূরত্ব নির্ভর করে বাউনীর উপরে। লাউ-কুমড়া চাষে ব্যবহৃত মাচান অথবা বেড়ার আকারে ফ্রেম তৈরি করে বাউনী দেওয়া যেতে পারে। বাউনী দেওয়ার সরঞ্জাম টেকসই হওয়া জরুরী, যেন ৫-৭ বছর এরা টিকে থাকতে পারে। চারা রোপণের ২ বছর পর থেকেই ফল ধরা শুরু হয়। ৫-৬ বছর ফল দিয়েই গাছ ক্রমশ দূর্বল হয়ে যায়। যেহেতু নতুন শাখায় ফল উৎপাদিত হয়, সেজন্যে মাঝে মাঝে ডালপালা ছাটাই করে দিতে হয়। এতে নতুন শাখা-প্রশাখা বের হওয়ার সুযোগ দিলে ফলন বৃদ্ধি পাবে। শীতকাল ছাটাই করার উপযুক্ত সময়।
১) বীজ দ্বারা
ফল থেকে বীজ আলাদা করে পানি দিয়ে ধুয়ে ছায়ায় শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যায়। এ বীজ সরাসরি বীজতলায় অথবা পলিব্যাগে বপন করে চারা তৈরি করা যায়। বীজতলায় ৮-১২ সেমি. দূরে ১-২ সে.মি গভীরে বীজ বপন করে খড় দ্বারা মালচ দিতে হয়। ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যে বীজ অংঙ্কুরিত হয়। চারা ২-৪টি পাতা সম্পন্ন হলে বীজ তলা থেকে তা তুলে পলিব্যাগে স্থানান্তর করা যায়। চারার বয়স ৩-৫ মাস হলে চারা ৩০-৪০ সেমি. লম্বা হলে রোপণের উপযু্ক্ত হয়।
আরও পড়ুনঃ মাশরুম চাষ পরিকল্পনা
২) কাটিং দ্বারা
৩-৪ টি পর্ব বিশিষ্ট শাখা কেটে বংশবিস্তার করা যায়। কাটিং করার সময় শাখার নীচের পর্ব হতে ১-২ সেমি. নীচে তেরেসা করে কাট দিয়ে নীচের পর্বসহ বীজ তলার মাটিতে ৪৫ ডিগ্রী কোন করে উত্তর-দক্ষিণ দিকে মুখ করে মাটিতে রোপণ করতে হবে। কাটিং রোপণের সময় উপরের অংশে ১-২ টি পাতা রেখে বাকি পাতা ফেলে দিতে হবে। ৩৫-৪৫ দিনের মধ্যে কাটিং এর সফলতা লক্ষ্য করা যায়। ৩-৫ মাস বয়সে চারা রোপণের উপযুক্ত হয়। কাটিং করার উপযুক্ত সময় মে-আগষ্ট। কাটিং এর চারায় মাতৃ গুনাগুন বজায় রাখে।
চারা রোপণ পদ্ধতি
চারা রোপণের জন্য উপযুক্ত সময় হচ্ছে মে-আগষ্ট। অর্যহাৎ এখনই উপযুক্ত সময়। ২-৪ মি. x ২.৫-৫.০ মি. দূরত্বে এ ফলের চারা রোপণ করা হয়। রোপণের জন্য ৫০ x ৫০ x ৫০ সেমি. আকারের গর্ত তৈরি করে প্রতি গর্তে ২০-২৫ কেজি পঁচা গোবর, ২০০-৩০০ ইউরিয়া ও টিএসপি এবং ৪০০-৫০০ গ্রাম এমপি সার প্রয়োগ করা হয়। চারা রোপণের পর মাটিতে উপযুক্ত আর্দ্রতা রাখার জন্য সেচ দিতে হবে। ভালো ফলনের জন্য ফুল আসা ও ফলের বিকাশের সময় মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকা দরকার। মাটির আর্দ্রতা সবসময় পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ফলে খরা মৌসুমেও সেচ প্রদান করা প্রয়োজন। তবে বর্ষাকালে যেন গাছের গোড়ায় পানি জমতে না পারে সেজন্য পানি নিকাশের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
পরাগায়নে অসঙ্গতি
প্যাশন ফলে পরাগায়ণের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এর বেগুণী জাতের ফলে ফুল ভোরবেলা ফুটে দুপুরে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু হলুদ জাতের ফুলে দুপুরবেলা ফুলে ফুটে বিকেলবেলা বন্ধ হয়ে যায়। ফুলের পরাগ চটচটে। পোকামাকড়ের সহায়তায় পরাগায়ন কার্যকরী হয়।
প্যাশন ফলে স্বপরাগায়নে সমস্যা হয়। কিছু কিছু জাতের ফলে পর-পরাগয়নেও সমস্যা দেখা দিতে পারে। পানির সংস্পর্শে ফেটে গিয়ে পরাগ কার্যকরিতা হারিয়ে ফেলে। বাংলাদেশে বৃষ্টির সময়ে প্যাশন ফলে ফুল ধরে। এজন্যে ফল ধারণে অসুবিধা দেখা দিতে পারে। কৃত্রিম পরাগায়ন করে ফল ধারণ বৃদ্ধি করা সম্ভব।
ফল সংগ্রহ
পাকার পর ফল মাটিতে ঝরে পড়ে। তখনই একে সংগ্রহ করতে হয়। হলুদ জাতে ফলন বেগুনী জাত অপেক্ষা অনেক বেশি। যদিও বেগুনী জাতের ফল উৎকৃষ্ট। হাওয়াই দ্বীপে প্রতি হেক্টরে ৫০ টন হলুদ ও ১৬ টন বেগুনী জাতের ফল উৎপন্ন হয়। পাকা ফল ৬৫℃ তাপমাত্রায় ও ৮৫-৯০% আর্দ্রতায় মাস খানেক সংরক্ষণ করা সম্ভব।
- বাংলাদেশে পঙ্গপাল আক্রমণের সম্ভাবনা - July 10, 2020
- রকমেলন চাষ ও এর পরিচর্যা - July 6, 2020
- ঘরোয়া উদ্ভিদের রোগ-বালাই নিয়ন্ত্রণ – দ্বিতীয় পর্ব - July 3, 2020