প্রাচীন রূপকথা জুড়ে আছে ড্রাগন নামক ভয়ংকর শক্তিশালী এক প্রাণীর গল্প। রূপকথার বা কোনো কল্পকাহিনির ড্রাগন নয়, একটা জলজ্যান্ত ফল। হ্যাঁ এখানে কথা বলা হচ্ছে ড্রাগন ফলের। এটি এক ধরনের ফণীমনসা (ক্যাক্টাস) প্রজাতির ফল, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে এর মহাজাতি হায়লোসিরিয়াস(অনেক মিষ্টি)। একে এক এক দেশে এক এক নামে অভিহিত করা হয়। গণচীন -এর লোকেরা এটিকে ফায়ার ড্রাগন ফ্রুট এবং ড্রাগন পার্ল ফ্রুট বলে, থাইল্যান্ডে ড্রাগন ক্রিস্টাল, ভিয়েতনামে সুইট ড্রাগন, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াতে ড্রাগন ফ্রুট নামে পরিচিত। অন্যান্য স্বদেশীয় নাম হলো স্ট্রবেরি নাশপাতি। ডিম্বাকৃতির উজ্জ্বল গোলাপি রঙের এই ফলের নাম শুনলে কেমন জানি অদ্ভুত মনে হয়। এ আবার কেমন ফল। এটা কি আদৌ খাবার উপযোগী কিনা মনে সন্দেহ জাগে। কিন্তু এই ফল বাংলাদেশে অনেক জনপ্রিয়তা লাভ করছে। এই চাষ করে অনেকেই কোটিপতি হচ্ছে। কথায় আছে “বৃক্ষরোপণ করে যে, সম্পদশালী হয় সে” এই প্রতিপাদ্য নিয়ে ঢাকার সাভারে আশুলিয়া মরিচকাটা গ্রামে রূম্পা চক্রবর্তী নামে এক ফলচাষি ১০ একর জমিতে সাড়ে ১৬ হাজার ড্রাগন ফলের চাষ করে সাফল্য অর্জন করেছেন। এছাড়া অন্যান্য অনেক চাষিরাও এই ফলের চাষ করে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হচ্ছে।
কেন এই ফলের নাম ড্রাগন?
ড্রাগন ফল দেখতে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও মনোমুগ্ধকর। পাতাবিহীন এই ফলটি দেখতে ডিম্বাকার ও লাল রঙের। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এই ফলের বাইরের খোসা দেখতে রূপকথার ড্রাগনের পিঠের মতো। এই রূপকথার ড্রাগনের মতো কিছুটা মিল থাকার জন্য একে ড্রাগন ফল বলে।
ড্রাগন গাছ দেখতে কেমন?
ড্রাগন গাছ দেখতে একদম ক্যাকটাসের মতো। গাছ দেখে অনেকেই একে চির সবুজ ক্যাকটাস বলেই মনে করেন। এশিয়ার মানুষের কাছে এ ফল অনেক জনপ্রিয়, হালকা মিষ্টি-মিষ্টি। এই ফলের খোসা নরম এটা কাটলে ভিতরটা দেখতে লাল বা সাদা রঙের হয়ে থাকে এবং ফলের মধ্যে কালজিরার মতো ছোট ছোট নরম বীজ আছে। নরম শাঁস ও মিষ্ট গন্ধ যুক্ত গোলাপি বর্ণের এই ফল খেতে অনেক সুস্বাদু। গাছ ১.৫ থেকে ২.৫ মিটার লম্বা হয়।
রাতের রাণী ড্রাগন ফুল
ড্রাগন ফুল গাছে শুধুমাত্র রাতে ফুল দেয়। ফুল লম্বাটে সাদা ও হলুদ রঙের হয়। অনেকটা ‘নাইট কুইন’ ফুলের মত। এ কারণে ড্রাগন ফুলকে ‘রাতের রাণী’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে । ড্রাগন ফলের গাছ লতানো ইউফোরবিয়া গোত্রের ক্যাকটাসের মত কিন্তু এর কোন পাতা নেই। ফুল স্বপরাগায়িত; তবে মাছি, মৌমাছি ও পোকা-মাকড় এর পরাগায়ণ ত্বরানবিত করে এবং কৃত্রিম পরাগায়নও করা যেতে পারে।ড্রাগন ফুলকে বলা হয় ‘মুন ফ্লাওয়ার’ বা ‘কুইন অব দ্য নাইট’। ফুল থেকে ডিম্বাকার ফল গঠিত হয়।
আরও পড়ুনঃ ছাদবাগানেই করুন গ্রীষ্মকালীন তরমুজের চাষ
ইতিহাস
ড্রাগনফলের উদ্ভিদতাত্বিক নাম Hylocereus undatus। এই ফল মূলত সেন্ট্রাল আমেরিকার প্রসিদ্ধ একটা ফল। সেন্ট্রাল আমেরিকাতে এ ফলটি ত্রয়োদশ শতাব্দীতে প্রবর্তন করা হয়। দক্ষিণ এশিয়া বিশেষ করে মালয়েশিয়াতে এ ফলের প্রবর্তন করা হয় বিংশ শতাব্দীর শেষে। তবে ভিয়েতনামে এ ফল সর্বাধিক বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়। বর্তমানে এ ফলটি দক্ষিণ আমেরিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ চীন, মেক্সিকো, ইসরাইল, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বাংলাদেশেও চাষ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত অনেকগুলো বিদেশী ফল প্রবর্তন করা হচ্ছে। তার মধ্যে এ্যাভোকেডো, ম্যাঙ্গোঁস্টিন, কিউই, স্ট্রবেরী, রাম্বুটান, লংগান, ল্যাংসাট, ব্রেড ফ্লুট, চেরী ফল, জাবাটিকাবা, পীচ ফল, ফ্লুট এবং ডুরিয়ান অন্যতম। এদের মধ্যে কিউই ও ডুরিয়ান ছাড়া প্রায় সব ফলই এদেশে কমবেশি হচ্ছে এবং কোন কোনটা থেকে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যাচ্ছে। যা দেখে অনেকে এসব বিদেশি ফলের বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করার চিন্তা-ভাবনা করছে। লক্ষ করা যাচ্ছে যে, এদেশের অনেক জায়গাতেই বিশেষ করে উত্তর বঙ্গ ও ময়মনসিংহে বাণিজ্যিকভাবে স্ট্রবেরী চাষ করা হচ্ছে। এছাড়া বিদেশী ফলগুলোর মধ্যে ড্রাগন ফলের চাষ সম্ভাবনাময়। গবেষকরা মনে করেছেন, এ ফলটি এদেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশে এ ফল প্রথম প্রবর্তন করে ২০০৭ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টার। এ সেন্টারের পরিচালক প্রফেসর ড. এম. এ রহিম এ ফলের জাত নিয়ে আসেন থাইল্যান্ড, ফ্লোরিডা ও ভিয়েতনাম থেকে। এখন এ সেন্টার থেকে এ ফলটি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বংশ বিস্তার করা হচ্ছে।
ড্রাগন ফলের ব্যবহার
ড্রাগন ফল কাচা বা পাকা অবস্থায় খাওয়া যায়। ড্রাগন ফল ফ্রিজে রেখে ঠাণ্ডা করে খেলে ভালো লাগে। ফলকে লম্বালম্বিভাবে কেটে ২/৪ টুকরা করে চামচ দিয়ে কুরে এর শাঁস খাওয়া যায়। এ ছাড়াও খোসা ছাড়িয়ে ছোট ছোট টুকরো করে কেটে কাঁটাচামচ দিয়ে খাওয়া যায়। এটা মুলত ফ্রুট সালাদ হিসেবে, মিল্ক শেক তৈরিতে,জুস তৈরির জন্যও ফলটি অত্যন্ত উপযোগী। এর ফুলও খাওয়া হয়।
পুষ্টি উপাদান
এ ফলটি প্রচুর পরিমানে ভিটামিন সি, মিনারেল এবং উচ্চ ফাইবার যুক্ত। জুস তৈরিতে জন্যও ফলটি অত্যন্ত উপযোগী।
প্রতি ১০০ গ্রাম ফলে —
ফাইবার ০.৯ গ্রাম,
ফ্যাট ০.৬১ গ্রাম,
ক্যারোটিন ০.০১২ গ্রাম,
পানি ৮৩.০ গ্রাম,
ফসফরাস ৩৬.১ মি. গ্রাম,
এসকোরবিক এসিড ৯.০ মি. গ্রাম,
রিবোফাবিন ০.০৪৫ মি. গ্রাম,
ক্যালসিয়াম ৮.৮ গ্রাম,
নায়াসিন ০.৪৩০ মি.গ্রাম,
আয়রন ০.৬৫ মি. গ্রাম,
কার্বোহাইড্রেট ৯ থেকে ১৪ গ্রাম,
প্রোটিন ০.১৫ থেকে ০.৫ গ্রাম,
চর্বি ০.১ থেকে ০.৬ গ্রাম,
অ্যাশ ০.৪ থেকে ০.৭ গ্রাম
ক্যালরি ৩৫ থেকে ৫০ থাকে।
এই লাল শাঁসের ড্রাগন ফলে ভিটামিন সি থাকে বেশি।
ড্রাগন ফলের উপকারিতা
এই ফল দেখতে খুব আকর্ষনীয়, এর কার্যকারিতা ও সুফলতা অনেক বেশি। এশিয়ার মানুষের কাছে এ ফল অনেক জনপ্রিয়, হালকা মিষ্টি-মিষ্টি, কোনোটা আবার হালকা টক।
আসুন জেনে নেই ড্রাগন ফলের উপকারিতা –
ক) ড্রাগন ফলে ক্যালোরির পরিমাণ খুব কম থাকে। তাই ডায়াবেটিস ও হৃদরোগীরা খেতে পারবেন।
খ) ড্রাগন ফলে ভিটামিন সি বেশি থাকার ফলে এই ফল খেলে আমাদের শরীরের ভিটামিন সি এর চাহিদা পূরণ হয়। লাল শাঁসের ড্রাগন ফল থেকে বেশি পরিমানে ভিটামিন সি থাকে।
গ) ড্রাগন ফলে আয়রন থাকার কারনে রক্ত শূন্যতা দূর হয়।
ঘ) ড্রাগন ফলে প্রচুর পরিমানে পানি থাকার কারনে এই ফল জুস আকারে খেলে শরীরের পানি শূন্যতা সহজেই দূর হয়ে যায়।
ঙ) নিয়মিত ড্রাগন ফল খেলে রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে থাকে। তাই এই ফল ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উত্তম।
চ) ড্রাগন ফলের শাঁস পিচ্ছিল হওয়ায় এই ফল খেলে কোষ্ঠ কাঠিন্য দূর হয়।
ছ) ড্রাগন ফলে প্রচুর ফাইবার থাকে যা পেটের পীড়া এবং লিভার এর জন্য ভালো।
জাত
বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সফলভাবে চাষ করার জন্য বাউ ড্রাগন ফল – ১ (সাদা), বাউ ড্রাগন ফল – ২ (লাল) নির্বাচন করা যেতে পারে। এছাড়া হলুদ ড্রাগন ফল, কালচে লাল ড্রাগন ফল চাষ করা যেতে পারে। দুটি জাত বাংলাদেশে চাষ করা হচ্ছে। ড্রাগন চাষের জন্য কাটিং চারাই বেশি উপযোগী। কাটিং থেকে উৎপাদিত গাছে ফল ধরতে ১২ থেকে ১৮ মাস সময় লাগে।
আরও পড়ুনঃ ছাদে ড্রাগন ফল চাষপদ্ধতি
উপযুক্ত সময়
ড্রাগন ফল সাধারণত সারা বছরেই চাষ করা যায়। এটি মোটামুটি শক্ত প্রজাতির গাছ হওয়ায় প্রায় সব ঋতুতেই চারা রোপন করতে পারেন। তবে ছাদে ড্রাগন ফল চাষ করে ভালো ফলন পেতে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসে চারা রোপন করলে আপনি অবশ্যই সুফল পাবেন।
- খোলা লোমকূপজনিত সমস্যা সমাধানে দৈনন্দিন সবজি - May 4, 2020
- মানসিক ও শারীরিক সুস্থতায় বাগানের কার্যকারিতা - April 22, 2020
- বাসা-বাড়ি পরিষ্কার এবং জীবাণুমুক্ত রাখার উপায় - April 12, 2020