মাশরুম হচ্ছে মূলত এক ধরনের ছত্রাক। এটি খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু। আমাদের দেশের বড় বড় শহরগুলোর বিভিন্ন হোটেল ও চাইনিজ হোটেলগুলোতে মাশরুমের চাহিদা আছে। তাই আপাত দৃষ্টিতে মাশরুমের বাজার মূলত শহরে গড়ে উঠেছে। এছাড়া বিদেশে এর চাহিদা রয়েছে। মাশরুম শুকিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। ঔষধি গুণসংবলিত সবজি হিসেবে গোটা পৃথিবীতেই এর আলাদা কদর রয়েছে। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে প্রতিনিয়ত কৃষিজমির পরিমাণ কমে চলেছে, সেখানে কৃষি সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে অন্যতম একটি মাধ্যম হতে পারে মাশরুম চাষ। কারণ এটি উৎপাদনে অতিরিক্ত জমির প্রয়োজন হয় না। ঘরের মধ্যে তাক বানিয়ে অথবা স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত সস্তা উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমেই এটি উৎপাদন করা যায়। মাশরুম চাষে খুব একটা বাড়তি মূলধনের প্রয়োজন হয় না। উৎপাদনে সময় লাগে অনেক কম। এর জন্য বিশেষায়িত কোনো প্রযুক্তির প্রয়োজন নেই। এমনকি কোনো ধরনের রাসায়নিকেরও প্রয়োজন হয় না। সে হিসেবে বলা যায়, গ্রাম ও নগরের প্রান্তিক ও স্বল্প আয়ের দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য সার্বক্ষণিক ও খণ্ডকালীন কর্মসংস্থানের উৎস হয়ে উঠতে পারে মাশরুম চাষ। একই সঙ্গে তা হয়ে উঠতে পারে অত্যন্ত লাভজনক ও আকর্ষণীয় কৃষিনির্ভর ক্ষুদ্র উদ্যোগ। বাংলাদেশে মাশরুম চাষের সম্ভাবনা নিয়ে পড়ুন।
প্রায় সাড়ে ৪ হাজার বছর আগে প্রাচীন মিসরীয়রা মাশরুমকে মনে করত অমরত্বের উৎস। সে সময় এক রাজকীয় অধ্যাদেশের মাধ্যমে জনসাধারণের জন্য মাশরুম উৎপাদন ও গ্রহণ নিষিদ্ধ করেছিল ফারাওরা। প্রাচীন আমলে ইউরোপে বেশ জনপ্রিয় ছিল মাশরুম। রোমানদের কাছে এটি ছিল দেবতার খাবার। চীন ও জাপানে ঔষধি হিসেবে মাশরুম ব্যবহার হয়ে আসছে কয়েক হাজার বছর ধরে। শুধু ইউরোপ বা এশিয়া নয়, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায়ও মাশরুম খাওয়ার চল ছিল। সেখানে বিশেষ ধরনের রহস্যময় গুণসংবলিত খাবার হিসেবে ছত্রাকটির বেশ জনপ্রিয়তা ছিল। প্রাচীন বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী আচার-অনুষ্ঠান ও ধর্মীয় কৃত্যে ব্যবহার হতো মাশরুম। তবে সবখানেই মাশরুমের একমাত্র উৎস ছিল প্রকৃতি।
আপনার বারান্দায় কিংবা ছাদেই করতে পারেন মাশরুমের চাষ। এজন্যে ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা মূলধন নিয়েই শুরু করতে পারেন।
মাশরুমের কোনো বীজ নেই। যা থাকে, তাকে বলা হয় স্পন। প্রতিটি স্পন থেকে প্রায় ২০০ গ্রাম মাশরুম পাওয়া যায়। সুতরাং ২০০টি স্পন থেকে প্রায় ৪০ কেজি মাশরুম পাওয়া সম্ভব হবে। বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি মাশরুমের দাম প্রায় ৩০০ টাকা।
মাশরুমের পুষ্টিগুণ
মাশরুম একটি পুষ্টিকর খাবার। এতে প্রচুরপরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ, আমিষ এবং হজমে সাহায্যকারী এনজাইম রয়েছে। এটা খেতেবেশ সুস্বাদু এবং সহজেই হজম হয়।
প্রয়োজনীয় উপকরণ
গামলা – ১টি
ছোট চা চামচ – ১টি
ব্লেড – ১টি
ছুরি – ১টি
পলিপ্রোপাইল ব্যাগ – ১০পিস
মাশরুম স্পন ২০০ টি বা ১০০ কেজি (পাওয়া যাবে ঢাকা জেলার সাভারে)
চাষের উপযোগী স্থান
মাশরুমের জন্য আবাদী জমির প্রয়োজন হয় না। মাশরুম চাষ করার জন্য ছায়াযুক্ত জায়গায় ছন বা বাঁশের চালা দিয়ে ঘর তৈরি করতে হয়। বাড়ির ছাদ ও বারান্দা এক্ষেত্রে বেশ উপযুক্ত। মাটির দেওয়াল বা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘর তৈরি করা যায়। ঘরের ভেতর যাতে আলো ঢুকতে না পারে সেজন্য বাঁশের বেড়ায় মাটি লেপে দিতে হবে।
মাশরুমের কিছু চাষযোগ্য জাত
আমাদের দেশে বেশ কয়েকটি জাতের মাশরুমের চাষ হয়। যেমন- অয়েস্টার মাশরুম, দুধ মাশরুম. কান মাশরুম, শিতাকে মাশরুম, খড় মাশরুম ইত্যাদি।
অয়েস্টার মাশরুম চাষ পদ্ধতি
অয়েস্টার মাশরুম স্পন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণ জোগাড় করে মাশরুম চাষ শুরু করা যাবে। ধাপে ধাপে মাশরুম চাষ করতে হয়।
প্রথম পদ্ধতি
মাশরুম চাষ কেন্দ্র থেকে মাশরুমের স্পন প্যাকেট সংগ্রহ করতে হবে। স্পনের দুই পাশে কিছুটা গোল করে কেটে চেঁছে নিতে হবে। মাশরুমের প্যাকেট পানিতে ৩০ মিনিটের জন্য ডুবিয়ে রাখতে হবে। ৩০ মিনিট পরে পানি থেকে মাশরুমের প্যাকেট উঠিয়ে নিতে হবে। অতিরিক্ত পানি ঝরানোর জন্য মাশরুমের প্যাকেট ৫ থেকে ১০ মিনিট উপুড় করে রাখতে হবে। পানি ঝরে গেলে ঘরের নির্ধারিত জায়গায় রেখে দিতে হবে। প্রতিদিন এর উপর তিন থেকে চারবার করে পানি ছিটিয়ে দিতে হবে।
সাধারণত ৩ থেকে ৪ দিন পর কাটা জায়গা থেকে অঙ্কুর গজায়। অঙ্কুর গজানোর পর মাঝে মাঝে পানি ছিটিয়ে দিতে হবে।
খাওয়ার উপযোগী মাশরুম উৎপন্ন হতে ৫ বা ৬ দিন সময় লাগে। খাবার উপযোগী মাশরুম উৎপন্ন হলে তা গোড়া থেকে তুলে নিতে হবে।
বীজের যে জায়গা কাটা হয়েছিল তা ব্লেড দিয়ে একটু চেঁছে দিতে হবে। এই বীজ থেকে আবার মাশরুম গজাবে।
একটা আধা কেজি ওজনের বীজ বা স্পন প্যাকেট থেকে ৩-৪ বার মাশরুম পাওয়া যায়। এতে মোট ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম মাশরুম পাওয়া যাবে।
দ্বিতীয় পদ্ধতি
মাশরুম চাষ কেন্দ্র থেকে বীজ বা স্পন সংগ্রহ করতে হবে। এক কেজি ওজনের একটি বীজের পলিথিন খুলে ভিতরের কম্পোস্ট গুঁড়ো করে নিতে হবে। দুই কেজি পরিমাণ ধানের পরিষ্কার ও শুকনো খড় সংগ্রহ করতে হবে। খড়গুলোকে এক ইঞ্চি মাপে কেটে টুকরো করে নিতে হবে।
পরিমাণ মতো পানি ফুটিয়ে নিতে হবে। খড়গুলো জীবাণুমুক্ত করার জন্য ফুটন্ত পানিতে খড়ের টুকরোগুলো এক ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। খড়গুলো পানি থেকে তুলে চিপে পানি শূন্য করে একটি পাত্রে রাখতে হবে।
পাঁচটি পলিব্যাগ নিয়ে পলিব্যাগের ভেতরে প্রথমে কিছু খড় বিছিয়ে নিতে হবে। খড়ের উপর মাশরুম বীজের গুঁড়ো দিতে হবে। এভাবে একটি পলিব্যাগে চার স্তরে খড় আর মাশরুম বীজের গুঁড়ো বিছিয়ে দিতে হবে। শেষ স্তরে আবার খড় বিছিয়ে দিতে হবে।
খড় বিছানো শেষ হলে খুব শক্ত করে পলিব্যাগ বাঁধতে হবে। এভাবে প্রতিটি পলিব্যাগ বাঁধতে হবে। পলিব্যাগের চার দিকে ১০-১২টি ছিদ্র করতে হবে। এরপর ব্যাগগুলোকে বীজে পরিণত হওয়ার জন্য ১৫-১৮ দিন রেখে দিতে হবে।
১৫-১৮ দিন পরে পলিব্যাগগুলো খুলে বীজের দলাগুলো বের করে নিতে হবে।
প্রতিটি বীজের দলা শিকায় করে ঝুলিয়ে রাখতে হবে এবং প্রতিদিন ৪-৫ বার করে পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। ৩-৪ দিন পর চারদিক দিয়ে মাশরুমের অঙ্কুর গজাতে শুরু করবে। ৪-৬ দিন পর খাওয়ার উপযোগী মাশরুম গোড়া থেকে তুলে নিতে হবে।
এভাবে মাশরুম চাষে লাভ বেশি হবে। কারণ প্রতিটি পলিব্যাগ থেকে প্রায় আধা কেজি মাশরুম পাওয়া যাবে। সুতরাং পাঁচটি ব্যাগ থেকে প্রায় আড়াই কেজি মাশরুম উৎপন্ন হবে।
মাশরুমের পরিচর্যা
১) মাশরুম বেডে বীজ বপনের পর থেকে গজানোর আগ পর্যন্ত তাপমাত্রা ৩৫-৪০ সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে হবে এবং মাশরুম গজাতে শুরু করলে তাপমাত্রা ৩০-৩৫ সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে হবে।
২) স্পনে কোনভাবেই সূর্যের আলো পড়তে দেওয়া যাবে না। সবসময় ঘরটি ঠান্ডা রাখতে হবে। খুব বেশি গরম পড়লে ঘরের চারদিকে বস্তা ঝুলিয়ে ভিজিয়ে রাখতে হবে। মাশরুম ঘর ও ঘরের বাইরের চারদিক সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
৩) পলিথিন দ্বারা ভালোভাবে ঢেকে তাপ বাড়ানো এবং খুলে দিয়ে তাপ কমানো যায়। কাজেই অবস্থার প্রেক্ষিতে তাপ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
৪) মাশরুম বেডকে পোকা-মাকড় ও জীব-জন্তুরউপদ্রব থেকে রক্ষা করতে হবে।
৫) মাশরুম বেড সব সময় ভেজা থাকা দরকার। বেডের উপরিভাগ শুকিয়ে গেলে মাঝে মাঝে হালকাভাবে পানি ছিটিয়ে আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন
মাশরুমে মাছির প্রকোপ দেখা দিতে পারে। এজন্য ম্যালাথিয়ন (০.১%) স্প্রে করা যেতে পারে। এছাড়া ফর্মালিডিহাইডে (৪%) তুলা ভিজিয়ে সানস্ট্রেটে ঘসে দিলে সবুজ বাদামী বা নীল মোল্ড দূর হবে।
মাশরুম সংগ্রহ
মাশরুম বেডে বীজ বপনের ১০-১৫ দিনের মধ্যে আলপিনের মাথার আকারে মাশরুম গজানোর লক্ষণ দেখা যায়। মাত্র ২ দিনের মধ্যে এ অবস্থা পেরিয়ে মাশরুম দেশী মুরগির ডিমের আকার ধারণ করে। এ অবস্থা মাশরুম সংগ্রহের উপযুক্ত সময়। সংগ্রহে বিলম্ব হলে মাশরুম ছাতার মতো হয়ে ফুটে যায় এবং এর স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। কাজেই সময়মত মাশরুম সংগ্রহ করা আবশ্যক। একটা বেড থেকে ২ সপ্তাহ পর্যন্ত দফায় দফায় মাশরুম সংগ্রহ করা যায়।
- বাংলাদেশে পঙ্গপাল আক্রমণের সম্ভাবনা - July 10, 2020
- রকমেলন চাষ ও এর পরিচর্যা - July 6, 2020
- ঘরোয়া উদ্ভিদের রোগ-বালাই নিয়ন্ত্রণ – দ্বিতীয় পর্ব - July 3, 2020
আমি মাশরুম চাষের প্রশিক্ষন নিতেচাই যোগা যোগের ঠিকানা জানাবেন কি?
সাভার মাশরুম ইন্সটিটিউট, ফোন নংঃ ০১৭২৯৫৭৪৫৫১