ছাদবাগানে সবসময়ই মাটির বিকল্প হিসেবে এমন কিছু খুঁজে থাকি, যা কিনা সহজে বহনযোগ্য, পরিচ্ছন্ন ও দ্রুত গাছ বেড়ে তুলতে সাহায্য করে। বর্তমানে শুধুমাত্র ছাদবাগানেই নয়, বাণিজ্যিক চাষের জন্যেও কোকোপিট মাটির উন্নত বিকল্প। শুকনো নারিকেলের আঁশ হলো কোকো পিটের মূল উপাদান। নারিকেল্র বাদামী ফেলে দেওয়া আঁশ সংগ্রহ করে মেশিনে প্রেস করে বাণিজ্যিকভাবে কোকোপিট ব্লক তৈরি করা হয়। এটির পানির সুনিষ্কাশন ব্যবস্থার কারণে যেকোনো গাছ খুব সহজেই বেড়ে উঠতে পারে।
নারিকেলের ৩৫-৬৫% অংশই হল এর আঁশ ও কয়ার এর অংশবিশেষ। নারিকেলের কয়ারের বাইরের আঁশযুক্ত অংশের বাইরে বহিঃত্বক থাকে। এই বহিঃত্বক এর ভেতরের মধ্যত্বকে আঁশ থাকে। ফলের কাষ্ঠল অংশকে কয়ার বলা হয়। এর গুড়ো অংশকেও কোকোপিট হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
সাধারণত এক-তৃতীয়াংশ অংশই আঁশ, বাকি দুই-তৃতীয়াংশ অংশ কয়ার পিথ হিসেবে একটি নারিকেল থেকে সংগ্রহ করা হয়। আগের দিনে নারিকেল ২-৩ মাস মানিতে চুবিয়ে রাখা হয়, যখন আঁশ নরম হয়ে আসত, তখন হাত দিয়ে এগুলো তুলে আনা হত। বর্তমানে হাইড্রোলিক মেশিন দিয়ে খুব সহজেই এগুলো তুলে ফেলা হয়।
১৯৮০ সালে প্রথম নেদারল্যান্ডে প্রথমবারের মতো কোকোপিটের ব্যবহার করে গোলাপ ও লিলিফুলের চাষ করা হয়। ফলাফল আশ্চর্যজনক হওয়ার পর বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশেই বাগান করতে কোকোপিটের ব্যবহার করা হচ্ছে।
কোকোপিট ব্যবহারের সুবিধা
ক) কোকোপিটে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি উপাদান আছে। এতে রয়েছে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, উচ্চতর পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়ামের মতো উপাদান।
খ) কোকোপিটে দ্রুত পানি ও বাতাস চলাচল করতে পারে ফলে গাছের শিকড় দ্রুত বাড়ে। গাছের শিকড় বাড়ার কারনে গাছও দ্রুত বাড়ে এবং স্বাস্থ্যবান হয়।
গ) কোকোপিটে দ্রুত পানি ও বাতাস আসা যাওয়ার কারনে ক্ষতিকারক ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করতে পারে না।
ঘ) কোকোপিটে রাসায়নিক সার না মেশালেও চলে। শুধু মাত্র ভার্মিকম্পোষ্ট অথবা জৈব সার মিশিয়ে চাষ করা যায় ফলে রাসায়নিক মুক্ত সবজি, ফল, ফুল, অর্কিড ও অন্যান্য গাছ উৎপাদন করতে পারবেন।
ঙ) কোকোপিটে আছে পানি ধরে রাখার অসাধারন ক্ষমতা। ১ কেজি কোকোপিট ১৫ কেজির মতো পানি ধরে রাখতে পারে। বিভিন্ন ঋতুতে এর পরিমাণ বিভিন্ন হয়ে থাকে। একবার কোকোপিট ব্যবহার করলে পানি দেওয়া নিয়ে দূঃশ্চিন্তা করার প্রয়োজনি পড়বে না।
চ) কোকোপিটের আর্দ্রতা ধরে রাখার ক্ষমতা ৬০০-৮০০ ভাগ।
ছ) গাছের জন্য যতটুকু পানি দরকার ঠিক ততটুকু পানি এই কোকোপিট ধারন করে রাখে ফলে গাছের শিকড়ে পঁচন ধরে না।
জ) কোকো পিটে প্রাকৃতিকভাবে অপকারী ব্যাকটেরিয়া এবং ফাঙ্গাস প্রতিরোধী উপাদান বিদ্যমান থাকে।
ঝ) কোকো পিটে প্রাকৃতিক মিনারেল থাকে যা উদ্ভিদের খাদ্য তৈরি এবং উপকারী অণুজীব সক্রিয় করার জন্য বিশেষ ভূমিকা রাখে।
ঞ) কোকোপিট দিয়ে গাছ লাগালে ক্ষতিকারক পোকা মাকড় আসে না।
ট) কোকোপিট মাটির তুলনায় পরিষ্কার ও পরিছন্ন ফলে যেখানে গাছ রাখবেন যেমন আপনার ঘর, বারান্দা ও ছাদ নোংরা হবে না সর্বসময় পরিষ্কার ও পরিছন্ন থাকবে।
ঠ) কোকো পিট ১০০% জৈব উপাদান সমৃদ্ধ
ড) জৈব উপাদান দিয়ে তৈরি হওয়ায় এ্রর উচ্চতর ক্যাটায়ন আদান-প্রদান ক্ষমতা রয়েছে। এটি প্রয়োজনানুসারে গাছের জন্যে পুষ্টি উপাদান নিঃসরণ করে। এটি পুষ্টির অপচয় রোধ করে।
ঢ) কোকোপিটকে মেশিনের সাহায্যে নিজের আকৃতির এক-পঞ্চমাংশ করে ফেলা খুবই সহজ। এজন্যে এটি খুবই সহজে পরিবহণযোগ্য
ণ) হাইড্রোপনিক উদ্ভিদ কোকোপিটে মাটির চেয়ে ৫০ ভাগ দ্রুত বাড়তে পারে।
ত) কোকোপিট ব্যবহার করলে সার ও কীটনাশকের ব্যবহার দরকার পরে না। যেহেতু কোকোপিটেই প্রয়োজনীয় উপাদান থাকে।
থ) কোকোপিটে প্রাকৃতিকভাবেই ট্রাইকোডার্মা থাকে যা কিনা বায়োএজেন্ট হিসেবে ক্ষতিকর প্যাথোজেন ও আগাছা প্রতিরোধ করে। এছাড়াও এটি উপকারী ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাস জন্মাতে সাহায্য করে।
দ) এটি শিকড়ের প্রাকৃতিক হরমোন হিসেবেও কার্যকরী।
ধ) কোকোপিটের পি এইচ মান ৫.৭-৬.৫ মাত্রার ধরে রাখতে সাহায্য করে।
ন) কোকপিটে পানি নিষ্কাশন খুব সহজেই হয়।
প) কোকোপিট ব্যবহার করলে গাছের মৃত্যুহার হ্রাস পায়।
ফ) কোকো পিট মাটির তুলনায় ওজনে অনেক গুন হালকা তাই গাছের টব বা পাত্র সহজে বহন করা যায়। আর ছাদের উপর অতিরিক্ত চাপও পড়েনা।
যেভাবে কোকোপিট ব্যবহার করবেন
প্রতি কেজি কোকোপিটের সাথে ৫ লিটার পানি মেশাবেন। পানি আস্তে আস্তে ঢালতে থাকবেন। কোকো পিট খুবই দ্রুত ফুলতে থাকবে। পানি শোষণ করা অংশটুকু হাত দিয়ে ঝুরঝুরে করে নিন। কোনো অংশে পানি না পড়লে সেগুলো আলাদা করে আবার আস্তে আস্তে পানি ঢালুন। খেয়াল রাখতে হবে যেন পানি পরিমাণের চেয়ে বেশি না পড়ে। এতে কোকোপিট ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়বে। আবার কম পানি হলে দলা দলা হলে যাবে। তাই চেষ্টা করবেন পানির অনুপাত ঠিক থাকে যেন।
আরও পড়ুনঃ ঘরোয়া উদ্ভিদের যত্ন-আত্তি
টবে বা বেডে কোকো পিট দিয়ে গাছ লাগানোর নিয়ম
প্রথমে একটি প্লাস্টিকের গামলায় আগে থেকে তৈরি করা সিক্ত কোকোপিট নিন। এর সাথে কোকো পিটের অর্ধেক ভার্মি কম্পোস্ট ভালো করে মিশিয়ে নিন। চাইলে পটিং মিক্সও মেশাতে পারেন। মেশানো হয়ে গেলে মিশ্রণটি দিয়ে আপনার পছন্দের টব অথবা বেড তৈরি করে গাছ বা গাছের চারা রোপন করে দিন। নিয়মিত পরিমান মত পানি দিবেন।
বড় ড্রামে কোকো পিট দিয়ে গাছ লাগানোর নিয়ম
প্রথমে একটি প্লাস্টিকের গামলার মধ্যে সিক্ত কোকোপিট ৫০%+ ভালো মানের ভার্মি কম্পোষ্ট সার ৩০% + ২০% ভালো মানের মাটি নিতে হবে। এদেরকে ভাল করে মিশিয়ে নিন। মেশানো হয়ে গেলে মিশ্রণটি দিয়ে আপনার পছন্দের ড্রামে গাছ বা গাছের চারা রোপন করে দিন। নিয়মিত পানি দিবেন।
- বাংলাদেশে পঙ্গপাল আক্রমণের সম্ভাবনা - July 10, 2020
- রকমেলন চাষ ও এর পরিচর্যা - July 6, 2020
- ঘরোয়া উদ্ভিদের রোগ-বালাই নিয়ন্ত্রণ – দ্বিতীয় পর্ব - July 3, 2020