শহরে নতুন আতঙ্ক, ডেঙ্গী বা প্রচলিত উচ্চারণে যাকে আমরা ডেঙ্গু নামে চিনি। ডেঙ্গুতে ইতোমধ্যে বিভিন্ন সুত্রে জানামতে প্রায় সাড়ে তিনলক্ষের অধিক মানুষ আক্রান্ত। প্রায় ৫০ এর অধিক মানুষ নিহতও হয়েছে। জনমুখে ডেঙ্গু এখন এক আতঙ্কের নাম।
এডিস মশার কামড়ে ৩-৪ দিনের মধ্যেই ১০৩-১০৬ ডিগ্রী পর্যন্ত জ্বর আসে। এরপর মাথা ব্যাথা, বমি ভাব হওয়া, শরীরের জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যাথা হয়, এছাড়াও ফুসকুড়ির দানা সারা শরীরে দেখা যায়।
ডেঙ্গু ঢাকা এখন মেট্রোপলিটনে বেশ আতংকের সাথে বিরাজ করছে। মেগাসিটির জনসংখ্যার চাপ আর বসবাসের অযোগ্য অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, এইসব মিলিয়েই শহরে মশার উৎপাত একটু বেশিই। এডিস মশার আক্রমণ প্রকোপ বেশি হয় বর্ষাকালে। আর হ্যা, এডিস মশা কিন্তু যেন তেন পানিতে ডিম পাড়বে না। তার জন্যে আপনাকে দিতে হবে পরিষ্কার পানি। যারা ভাবছেন ঢাকা শহরের নর্দমা, ড্রেন, পচা ডোবা এডিস মশার জন্মভূমি, আসলে ঠিক তা নয়। ওসব সাধারণ মশাদের প্রজনন ও বসবাস স্থান। এডিস মশা একটু অভিজাত, এরা পরিষ্কার পানি ছাড়া ডিমই পাড়ে না।
এবার ভাবুন তো, শহরে স্রোতবিহীন পরিষ্কার পানি ঠিক কই পাবেন? হ্যা, আপনার আশেপাশেই কিংবা আপনার বাড়িতেই তৈরি করে ফেলেছেন এডিস মশার আবাসস্থল। বর্ষাকালে বৃষ্টিতে বিভিন্ন শুকনো ডোবা, গর্ত, টব, পাত্র, ডাবের খোসা, চিপসের প্যাকেট ইত্যাদি যদি সামান্য কয়েক ঘন্টার জন্যেও পানি জমে থাকে, এডিস মশা সেখানেই বংশবৃদ্ধি করে ফেলতে পারবে। সিটি কর্পোরেশনকে সব দোষ দিয়ে লাভ নেই। আপনি চিপস খেয়ে যে খোসাটি, বা জ্যুস খেয়ে যে প্লাস্টিকের বোতলটি ফেললেন সেখানেই একটু পর বৃষ্টির পানি জমে মশা বংশবৃদ্ধি করে ফেলতে পারে।
বাগান তৈরিতে যেসব সতর্কতা
যারা শখের বসে এবং পরিবারের জন্যে টাটকা খাদ্য যোগানের জন্যে ছাদে ও বেলকুনিতে বাগান করে থাকেন, তারা কিন্তু মশার বংশবিস্তারের একটা উপায় করে দিচ্ছেন। গাছের ঘন জঙ্গলে কখনোই এডিস মশা জন্মাবে না। এজন্যে বাগানীদের কিছু ব্যাপারে সচেতন থাকা অবশ্য জরুরি।
১) টবের মাটির স্তর
আপনার টবটিতে যদি মাটি দিয়ে ভরাট করা না থাকে, তাহলে খালি অংশে পানি জমে এডিস মশা বংশবিস্তার করতে পারে। তাই মাটি দিয়ে ভরাট করে ভরাট করে দিবেন যেন পানি জমার সুযোগ না থাকে।
২) ছাদে পানি জমা
বাগান করতে গেলে নিশ্চয়ই পানি দিতে হয় নিয়মিত। অনেক সময় অতিরিক্ত পানি দেওয়ার ফলে বা বৃষ্টি থেকে কিছু পানি ছাদে জমা থাকতে পারে। এ থেকে এডিস মশা বৃদ্ধি পেতে পারে। সবসময় আপনার ছাদকে পানিমুক্ত রাখুন।
৩) টবের নিচে ছিদ্র না থাকা
টবের নিচে অতিরক্ত পানি বেরিয়ে যাওয়ার ছিদ্র না থাকলে পানি জমে যেতে পারে। অবশ্যই ছিদ্র করে ফেলুন এখনই।
৪) পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না রাখা
ছাদবাগানে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভাল না থাকলে মশার বিস্তার বেড়ে যেতে পারে। আপনার ছাদবাগানে পানির নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভাল কিনা, তা অবশ্যই জেনে নিবেন।
৫) টায়ার ব্যবহার
অনেকে ছাদবাগানে গাছ লাগানোর জন্যে টায়ার ব্যবহার করে থাকেন। টায়ারের খোলে খুব সহজেইই পানি জমে থাকে যা অনেকসময় টের পাওয়া যায় না। যারা টায়ার ব্যবহার করে নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখবেন।
ছাদবাগানের ক্ষতিকর দিক তো জানলাম। এবার আসি প্রাকৃতিকভাবে কিভাবে ডেঙ্গুর মোকাবেলা করব। এর আগে আমরা মশা মাছি, পোকামাকড় দূরে রাখে যেসব গাছ, সে সম্বন্ধে জেনেছিলাম। আপনার ছাদে বা বাসার ভিতরে অবশ্যই এসব গাছ রাখাবেন। মশার উপদ্রব থেকে সামান্য কিছু হলেও উপকার পাবেন।
এছাড়াও আপনার ঘরের জন্যে কিছু টোটকা আইডিয়া ব্যবহার করতে পারেন।
লেবুর মাঝ থেকে কেটে কিছু লবঙ্গ গেথে আপনার ঘরের বিভিন্ন স্থানে রেখে দিন। ঘরে কোনো মশা থাকবে না। এছাড়াও রসুনের কোয়া সিদ্ধ করে সেই পানি সারা ঘরে ছিটিয়ে দিলে মশার উপদ্রব কিছুটা হলেও কমবে।
শরীরে জ্বর জ্বর ভাব দেখা দিলেই নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে Dengue NS1 পরীক্ষাতি করিয়ে ফেলুন। সরকার নির্ধারিত ৫০০ টাকায় যেকোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এই হেলথটেস্ট করতে পারবেন। ডেঙ্গু পজিটিভ হলে ঘাবড়াবেন না। ডেঙ্গুর তেমন কোনো ঔষধ নেই, ঘরে থেকে বিশ্রাম ও সঠিক ফ্লুইড জাতীয় খাবার অনবরত গ্রহণ করে যেতে হবে।
ডেঙ্গুতে রক্তের প্লাটিলেট কমে যায়। প্লাটিলেট কি? প্লাটিলেট হল সহজ বাংলায় যাকে মরা অণুচক্রিকা নামে চিনি। অণুচক্রিকা বা প্লাটিলেট আমাদের শরীরের অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ বাধাগ্রস্থ করে, কেটে গেলে রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে থাকে। স্বাভাবিক রক্তে দেড় থেক চার লক্ষ পর্যন্ত প্লাটিলেট থাকে। এর থেকে কমে গেলেই শরীরে অস্বাভাবিক পরিবর্তন আসে। ২০ হাজারের নিচে এলে তো যেকোনো সময় রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যেতে পারে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে খাদ্য
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের শরীরে প্লাটিলেটের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে কমতে থাকে। এর অভাব পুরোন করতে খেতে হবে খনিজ সমৃদ্ধ তরল, প্রোটিন ও এনার্জি বৃদ্ধি করা খাবার। স্বাভাবতই ডেঙ্গু রগীরা খেতে চাইবে না। তাদেরকে নিয়মিত কিছু খাবার খেতে দিতে হবে।
ক) লেবুর রস
অবশ্যই রাস্তায় বানানো লেবুর শরবত নয়। লেবুতে আছে প্রচুৎ পরিমাণে ভিটামিন সি। বাসায় বানানো লেবুর রসের শরবত রোগীকে খেতে দিতে হবে।
খ) অ্যালোভেরার রস
অ্যালোভেরা রক্ত বিশুদ্ধ করে। এছাড়াও এর কিছু ভেষজগুণ আছে। নিয়মিত অ্যালোভেরার জ্যুস তৈরি করে রোগীকে খাওয়াতে হবে।
গ) পেঁপে পাতার জ্যুস
পেঁপের পাতা রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণ বাড়ায়। পেঁপের পাতা খুবই স্বাস্থ্যকর ও ভেষজ গুণে গুনান্বিত। পাতা বেলেন্ডারে বা হামানদিস্তায় থেতলে রস নিয়ে খেলে বেশ উপকারিতা পাবেন। তবে এটি একটু তেতোস্বাদযুক্ত। মধু মিশিয়ে খেতে দিতে পারেন।
ঘ) আনার বা বেদানা
ডালিমও নামেই বেশিরভাগ মানুষ আমরা চিনি। ডালিমের স্বাস্থ্যগুণ আমরা সবাইই কম বেশি জানি। ডালিমে উপস্থিত আয়রণ প্লাটিলেটের পরিমাণ বাড়ায়। ১৫০ মিলি ডালিমের জ্যুস ২ সপ্তাহ খেলে রোগী অনেক উপকারিতা পাবেন।
এছাড়াও বিভিন্ন রকম স্যুপ, প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার, জাউ, ভাত এসব রোগীকে খেতে দিতে হবে। প্রতিদিন আড়াই থেকে ৩ লিটার পর্যন্ত পানি রোগীকে খাওয়াবেন।
- বাংলাদেশে পঙ্গপাল আক্রমণের সম্ভাবনা - July 10, 2020
- রকমেলন চাষ ও এর পরিচর্যা - July 6, 2020
- ঘরোয়া উদ্ভিদের রোগ-বালাই নিয়ন্ত্রণ – দ্বিতীয় পর্ব - July 3, 2020