করোনার মতো অদৃশ্য রোগের হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রথমত প্রয়োজন সতর্কতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। নিজেকে পরিষ্কার রাখার পাশাপাশি নিজের বাড়িকেও পরিচ্ছন্ন রাখাও জরুরী। এই হোম কোয়ারেন্টাইনে বসে বসে সময় নষ্ট না করে নিজ বাড়ি-ঘর। আসবাবপত্র পরিচ্ছন্ন করার কাজে লেগে পড়ুন। রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রগুলি সুপারিশ করে যে, আমরা সকলেই যেন আমাদের বাড়ির যেসব জিনিস অধিক ব্যবহার করে থাকি, সেগুলোর পৃষ্ঠগুলি পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। আমরা আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসগুলোকে জীবাণুমুক্ত এবং পরিষ্কার রাখতে আপনাকে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে তা উল্লেখ করা হল।
নিয়মিত হাত ধুতে থাকুন
এখন অবধি এটি আপনি লক্ষবার শুনেছেন। কোভিড -১৯ ঝুঁকি কমিয়ে দেওয়ার সবচেয়ে ভাল উপায় হ’ল কিছু সময় পর পর আপনার হাত ধুয়ে নেওয়া। কাশি, হাঁচির পর বা অন্য এক জায়গা থেকে বাসায় চলে আসার পর হাত ধুতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, মুদি দোকান থেকে ফেরার পর হাত ধুয়ে নেওয়া উচিত। আপনার কাছে যদি হ্যান্ড স্যানিটাইজার থাকে তাহলে তা কোথাও যাওয়ার সময় নিজের কাছে রাখুন। এটি যেকোনো পরিস্থিতিতেই পানি ছাড়াই হার পরিষ্কার করতে সহায়তা করে। হ্যান্ড স্যানিটাইজার হল সাবান এবং পানি দিয়ে হাত ধোয়ার বিকল্প পদ্ধতি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধোয়ার জন্যে নির্দেশ দেয়।
সেই সাথে সাথে হাতকে ময়েশ্চারাইজ করাও গুরুত্বপূর্ণ । শুকনো, ফাটলযুক্ত ত্বক সকল ধরণের সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকে, তাই ধুয়ে নেওয়ার পরে, কিছুটা ময়েশ্চারাইজার লাগান। বেশিরভাগ ময়শ্চারাইজিং লোশনগুলিতে পানি এবং গ্লিসারিন উপাদান থাকে, তাই ব্র্যান্ডটি আসলে কিছু যায় আসে না। আপনার হাতে যেকোনো ব্রান্ডের লোশন লাগাতে পারেন।
বাড়িতে থাকুন
আপনি অসুস্থ না হলেও ঘরেই থাকুন। প্রচুর জনসমাগমের মধ্যে থাকা বা রেস্তোঁরাগুলিতে বের হওয়া কেবল নিজের জন্যেই নয় বরং আপনার আশপাশের মানুষের জন্য অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি তৈরি করে। আপনি যত বেশি অন্যদের সাথে মেলামেশা করবেন, ভাইরাসটি আপনার হাত, জামাকাপড় থেকে ছড়াতে পারে হাজার হাজার মানুষের মধ্যে। নিজেকে ঝুঁকির মধ্যে না ফেলে ঘরে অবস্থান করাই নিরাপদ। বিশেষত শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তি বা যাদের ইমিউনতন্ত্র দূর্বল প্রকৃতির তাদের বাসায় থাকতে হবে। বিশেষ করে যাদের হাপানী, ডায়বেটিস, হৃদরোগ ইত্যাদির প্রকোপ রয়েছে।
সুরক্ষিত থাকার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিধি
ক) জনসমক্ষে অন্যান্য ব্যক্তিদের থেকে কমপক্ষে তিন ফুট দূরে থাকুন।
খ) যদি আপনার কাশি বা হাঁচির সমস্যা থাকে, তবে মাস্ক পড়ুন।
গ) যারা অসুস্থ বা অসুস্থ ব্যক্তির যত্ন নিচ্ছে এমন লোকদের জন্য পরিপূর্ণ পোষাক যেমন পিপিই ও মাস্কের ব্যবস্থা করতে হবে।
ঘ) হাঁচি ও কাশির মাধ্যমে আক্রান্তর সংস্পর্শে থাকা অপর ব্যক্তি আক্রান্ত হতে পারে। করোনাভাইরাসের স্পাইক কোষের প্রোটিনের সাথে সংযুক্ত হওয়ায় কোষের হোস্ট কোষের গ্রাহকপ্রান্তের মিথস্ক্রিয়াই সংক্রাম্যতা সৃষ্টি করে এবং প্রজাতির ব্যাপ্তি ঘটে এক ব্যক্তি থেকে অপর ব্যক্তির মধ্যে। উদাহরণস্বরূপ, সার্স করোনাভাইরাস অ্যাঞ্জিওটেনসিন-রূপান্তরিত এনজাইম ২ (SE-2) মানবকোষে সংযুক্তির মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটায়।
ঙ) করোনভাইরাসটি যেহেতু ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে সংস্পর্শ বা শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। তাই আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে প্রায় ছয় ফুটের মতো দূরত্ব বজায় রাখা উচিত।
আরও পড়ুনঃ লাইফ হ্যাকসঃ বাড়িতেই বানান হ্যান্ড স্যানিটাইজার
আপনার বাসাকে পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত রাখতে
আমরা সাধারণত যে জিনিসটি জানি না তা হল পরিষ্কার রাখা এবং জীবাণুমুক্ত রাখা দুটি এক বিষয় নয়, দুটিই আলাদা ব্যাপার। পরিষ্কার করা মানে কোনো একটি বস্তুর বহিঃপৃষ্ঠ থেকে দূষক অপসারণ করা এবং জীবাণুমুক্তকরণ রোগজীবাণু ধ্বংস করা। CDC (Centers for Disease Control and Prevention) সুপারিশ করে যে আপনার বাড়ির কেউ অসুস্থ না থাকলেও আমাদের আশেপাশকে যেন পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করি। এর মূল লক্ষ্য হল দেশের রোগ-বালাই নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা। বিশেষত সংক্রামক ব্যাধি , খাদ্যজনিত জীবাণু , পরিবেশগত স্বাস্থ্য , পেশাগত সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্য ও আঘাত প্রতিরোধ এবং দেশের নাগরিকদের স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন করা।
বাহ্যিকভাবে সংক্রমণের চেয়ে ব্যক্তি-ব্যক্তি থেকে সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি, তবে সুপারিশ করা হয় যে, বাইরের পরিবেশ থেকে ফিরে নিরাপদ থাকতে প্রতিদিন কমপক্ষে একবার হলেও আমাদের বাড়ির দৈনন্দিন ব্যবহৃত তৈজসপত্রগুলি পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত রাখা।
আপনার দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসগুলির প্রতি খেয়াল রাখুন
গবেষকরা খুঁজে পেয়েছেন যে নভেল করোনা ভাইরাসটি ২৪ ঘন্টা কার্ডবোর্ডের মতো পৃষ্ঠে বাস করতে সক্ষম। তবে প্লাস্টিক এবং স্টেইনলেস স্টিলের উপর দুই বা তিন দিন অবধি থাকতে পারে। সুতরাং বেশি ব্যবহার্য জিনিসগুলির পৃষ্ঠতল সবসময় পরিষ্কার এবং জীবাণুনাশক করা উচিত।
পরিষ্কার এবং জীবাণুমুক্ত করার জন্য দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসগুলি হল-
১) দরজার হাতল
২) টেবিলের উপরি পৃষ্ঠতল
৩) ডাইনিং চেয়ার (সিট, পিছন এবং হাতল)
৪) রান্নাঘরের তাক
৫) বাথরুমের তাক
৬) কল
৭) টয়লেট (সিট এবং হ্যান্ডেল)
৮) সুইচ
৯) জানলার গ্রিল
১০) ফার্নিচারের উপরি পৃষ্ঠ (সোফা, শো-কেস, ড্রেসিং টেবিল ইত্যাদি)
১১) টিভি রিমোট
১২) গেম কন্ট্রোলার
১৩) ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন
প্রত্যেকের বাড়িই আলাদা, সুতরাং আপনি যে পৃষ্ঠগুলির সাথে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন, সেগুলি সম্পর্কে জানুন ও পরিষ্কার রাখুন।
আরও পড়ুনঃ করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় যা খাবেন
প্রথমে পরিষ্কার, তারপর জীবাণুমুক্ত
ক) প্রথমে কোনও দূষিত পদার্থ, ধূলা বা ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে পৃষ্ঠতল পরিষ্কার করুন। আপনি সাবান পানি (বা একটি পরিষ্কারক স্প্রে) এবং একটি তোয়ালে দিয়ে সেগুলি মুছে ফেলুন।
খ) এরপরে এর উপরিপৃষ্ঠে জীবাণুনাশক প্রয়োগ করুন। এর দ্রুত এবং সহজ সমাধান হল জীবাণুনাশক দিয়ে ভেজানো কাপড় দিয়ে ঘষা কিংবা জীবাণুনাশক স্প্রে ব্যবহার করা।
এই পন্থাসমুহ আপনার প্রতিদিনকার রুটিনে যুক্ত করার মাধ্যমে আপনার পরিবারের সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস করতে সহায়তা করবে। আপনি যদি এই মুহুর্তে হাতের নাগালে কোনো প্রকার জীবাণুনাশক না পান তবে আপনার বাসায় ব্যবহৃত সাবান বা পরিষ্কারক এজেন্ট দিয়ে কাজ সেরে ফেলুন। স্যাভলন বা ডেটল পানি এক্ষেত্রে ভাল কাজ করে।
জীবাণুনাশক স্প্রে (ক্লোরক্স, লাইসোল, স্যাভলন, ডেটল স্প্রে যা কাজ করবে)
ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ঘরেই জীবাণুনাশক ঐরি করার একটি দুর্দান্ত রেসিপিও রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ব্লিচিং পাউডার দিয়ে দুই ধরনের জীবাণুনাশক তৈরি করা যায়—একটি বেশি ঘনত্বের ও অন্যটি কম ঘনত্বের। বেশি ঘনত্বের জীবাণুনাশক দিয়ে অধিক সংক্রামক বর্জ্য, হাসপাতালের বর্জ্য, রাস্তাঘাট পরিষ্কার করার কাজে ব্যবহার করা হয়। আর কম ঘনত্বের জীবাণুনাশক দিয়ে বাসাবাড়ির পরিচ্ছন্নতার কাজ করা যায়। যার মধ্যে রয়েছে ঘরের ফার্নিচার, মেঝে, গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ইত্যাদি।
কীভাবে ঘরে তৈরি ব্লিচ জীবাণুনাশক স্প্রে তৈরি করবেন
বেশি ঘনত্বের জীবাণুনাশক তৈরির পদ্ধতি
উপাদানঃ
১) পানি – ২ লিটার
২) ব্লিচিং পাউডার – ১ টেবিল চামচ
এই দ্রবণটির অনুপাত হতে হবে ১:১০। অর্থাৎ দুই লিটার পানিতে এক টেবিল চামচ ব্লিচিং পাউডার যোগ করে তা পুরোপুরি মেশার জন্য ৩০ মিনিট অপেক্ষা করুন।
কম ঘনত্বের জীবাণুনাশক তৈরির পদ্ধতি
উপাদানঃ
ক) পানি – ২০ লিটার
খ) ব্লিচিং পাউডার – ১ টেবিল চামচ
এই দ্রবণটির অনুপাত হতে হবে ১ঃ১০০। অর্থাৎ ২০ লিটার পানিতে ১ টেবিল চামচ ব্লিচিং পাউডার যোগ করে তা পানিতে পুরোপুরি দ্রবীভূত হওয়ার জন্য ৩০ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। মেশার পর কোনো স্প্রেয়ার বোতলে এটি সংরক্ষণ করা যাবে।
ব্যবহারের নিয়ম
জীবাণুমুক্ত করার জন্য পৃষ্ঠতলে স্প্রে করুন, ১০ মিনিট অপেক্ষা করুন, এরপর ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে দিন।
ব্লিচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত সংবেদনশীল পৃষ্ঠগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত বা বর্ণহীনতার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে। তাই এটি ব্যবহারের সময় গ্লাভস পড়তে ভুলবেন না।
আপনার খাবার ও স্ন্যাক্স কি জীবাণুমুক্ত করা উচিত?
না, কোন কারণ ছাড়া নয়। FDA অনুযায়ী, খাবার বা খাবারের প্যাকেজিং করোনভাইরাস ছড়াতে পারে, এমন কোনো ভ্যালিড প্রমাণ নেই , সুতরাং বর্তমানে আপনার নিজের চেয়ে খাবার বা খাবারের প্যাকেজিংকে জীবাণুমুক্ত করার কোনই প্রয়োজন নেই। খালি স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করুন।
কীভাবে আপনার ডিভাইসসমূহ (মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট, আইফোন, ল্যাপটপ) জীবাণুমুক্ত করবেন?
লকডাউনে সবাই ঘরে বসে বেশ ধুমিয়ে ফোন, ল্যাপটপ, ডেস্কটপ ব্যবহার করছি। অনেক সময় আমরা আমাদের এইসব যন্ত্রগুলোকে পরিষ্কার করতে ভুলে যাই বা কিভাবে পরিষ্কার করব তা নিয়ে ওয়াকিবহাল নই। অনেকের কাছেই হয়ত এসব ডিভাইস বা যন্ত্রগুলো পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করা জটিল লাগতে পারে। তবে আপনি ও আপনার পরিবারের সদস্যরা ব্যবহার করছে এমন সব ডিভাইসগুলির দ্বারা বিভিন্ন ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণ হতে পারে। তাই এগুলিও পরিষ্কার এবং জীবাণুনাশিত করা অতি প্রয়োজন। আপনার অ্যান্ড্রয়েড বা আইফোনকে একটি জীবাণুনাশক প্যাড বা অ্যালকোহল সলিউশন (যেমন হেক্সিসল) দিয়ে জীবাণুমুক্ত করুন। জীবাণুনাশক ব্যবহারের পূর্বে নিশ্চিত হয়ে নিন যে স্ক্রিন, বাটন এবং যে কোনও প্রকার ধূলিকণা মুছে ফেলেছেন।
বেশিরভাগ ডেস্কটপ কম্পিউটারগুলির একটি পরিষ্কারের জন্য সর্বোত্তম উপায় হ’ল জীবাণুনাশক প্যাড বা আইসোপ্রপিল অ্যালকোহল দ্রবণ এবং একটি নরম তোয়ালের ব্যবহার। আবার, মনিটরে এসব জলীয় দ্রবণ দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা থেকে এড়িয়ে চলুন, কেননা এরা স্ক্রিনে গড়িয়ে পড়ে আপনার মনিটরকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে। তবে অবশ্যই আপনার সবচেয়ে বেশি ব্যবহার্য মাউসটি উপরে, পাশে এবং নীচে ঠিকভাবে মুছে রেখেছেন। আপনার কীবোর্ডের বাটন গুলি, কীবোর্ডের বাহ্যিক অংশ এবং আপনার যে কোনও মাউসপ্যাড এগুলো ভালোভাবে জীবানুমুক্ত করুন।
আনুষাঙ্গিক যন্ত্রাংশগুলি ভুলে যাবেন না
অন্য যে কোনও বৈদ্যুতিক ডিভাইসসমূহ যদি বহিরাংশ প্লাস্টিকের হয় (যেমন গেমিং মাউস, গেমপ্যাডস, টিভি রিমোট) এগুলোকে একটি জীবাণুনাশক প্যাড বা আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহল দ্রবণ দিয়ে নিয়মিত পরিষ্কার করা নিরাপদ।
জীবাণুনাশক হাতের নাগালে না থাকলে সাবান এবং পানি ব্যবহার করা কার্যকরি সমাধান হতে পারে।
- খোলা লোমকূপজনিত সমস্যা সমাধানে দৈনন্দিন সবজি - May 4, 2020
- মানসিক ও শারীরিক সুস্থতায় বাগানের কার্যকারিতা - April 22, 2020
- বাসা-বাড়ি পরিষ্কার এবং জীবাণুমুক্ত রাখার উপায় - April 12, 2020