ঝিঙ্গা বাংলাদেশের একটি গ্রীষ্মকালীন বা বর্ষাকালীন অনেক পুষ্টিকর সবজি। স্থানভেদে এর সংস্কৃত নাম ধারা কোষাতকী, বাংলা নাম ঝিঙ্গা বা ঝিঙ্গে, হিন্দীতে ঝিমানি ও তামিলে ভেরিবিরা নামে পরিচিত। আঠারোশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় উদ্ভিদবিজ্ঞানী মিশরীয় আরবি নাম লুফ থেকে এর ইংরেজী লুফফানামকরণ করেন। একে ভিয়েতনামী লাউ বা ভিয়েতনামী ধুন্দল বা চীনা অক্রা নামেও ডাকা হয়। বাংলাদেশে অঞ্চলভেদে একে তড়ই বা রামতরই ডাকা হয়। তড়ই বলতে ছোট ঝিঙ্গার জাতকে বোঝায়। এর উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Luffa, acutangula Roxb, x। আর এটি Cucurbitaceae বর্গের অন্তর্গত। ঝিঙ্গা হলো বর্ষজীবী লতাগাছ, গাছের মসৃণ গাঁট থেকে নতুন কান্ড বের হয় ও পরিনত সময়ে ফুল ও ফল হয়। সাধারনত লতাটি বেড়ায় গায়ে, মাচায় ও অন্য গাছকে আশ্রয় করে প্রসারিত হয়ে থাকে। লাউ কুমড়োর মত ঝিঙ্গারও দুই রকমের ফুল হয়। এর ফুল হলুদ রঙের হয়ে থাকে। সন্ধ্যার আগে ফুল ফোটে। সবুজ রঙের সব্জি বোঁটার দিক থেকে চিকন হয়ে আস্তে আস্তে মোটা হতে থাকে এবং সব্জিটি দেখতে শিরসম্পন্ন, এজন্য এর নাম ধারা কোষাতকী। সবজির ভিতরে প্রকোষ্ঠগুলি দেখতে যেন জাল বুনে তৈরী, সেটা দেখা যায় ফল পাকলে। প্রকোষ্ঠের মধ্যে অনেকগুলি বীজ থাকে। এগুলি দেখতে অনেকটা ডিম্বাকৃতি ও চেপ্টা।
আরও পড়ুনঃ আলুর ৯ টি মারাত্মক রোগ ও এর প্রতিকার
ব্যবহার
ঝিঙ্গা মূলত সবজি হিসেবে বিভিন্ন তকারির সাথে বা মাছ দিয়ে রান্না করে খাওয়া হয়। এছাড়াও এর ফুল, পাতা বিভিন্ন ঔষধি কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
পুষ্টি উপাদান
ক) ঝিঙ্গার প্রতি ১০০ গ্রাম অংশের মধ্যে রয়েছে-
খ) প্রোটিন=০.৫ গ্রাম
গ) ভিটামিন সি = ৫ মি গ্রা
ঘ) বিটা-ক্যারোটিন = ৩৩.৬ মাইক্রো গ্রাম
ঙ) ফসফরাস = ২৭ মি গ্রা
চ) ক্যালসিয়াম = ১৮ মি গ্রা
পুষ্টি গুণাগুণ
ক) পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য আঁশ থাকায় তা হজমের জন্য সাহাযু করে।
খ) এর জলীয় অংশ পানিশূণ্যতা দূর করতে সাহায্য করে।
গ) রক্তে কোলেস্টেরল দূর করতে সাহায্য করে।
ঘ) ঝিঙ্গার খাদ্যশক্তি শারীরিক দূর্বলতা কাটিয়ে প্রয়োজনীয় শক্তি যোগাতে সাহায্য করে।
ঙ) ভিটামিন সি রয়েছে যা রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। এমনকি ক্যান্সারের জীবাণু প্রতিরোধে সাহায্য করে।
চ) নিয়মিত ঝিঙ্গা খেলে লিভার সুরক্ষিত থাকে।
ছ) ঝিঙ্গা দেহের বিষাক্ত উপাদান বের করতে সাহায্য করে।
জ) হার্ট এটাক রোধে সাহায্য করে।
ঔষধি গুণাগুণ
ক) মাথার ব্যাথায় কাচা ঝিঙ্গের রস ২/৩ ফোটা করে নাকে টেনে নিলে এবং সেই সঙ্গে ১/২ চা চামচ করে রস আয়ুর্বেদ মতে, ঝিঙ্গার রস ক্রিমিনাশক, ক্ষুধা বর্ধক ও বেদনাশক হিসেবে কাজ করে। এছাড়া ঝিঙ্গার পাতার রস পিত্ত প্রশমক, মূত্রকারক, প্লীহারোগে, রক্তস্রাবে ও কুষ্ঠ রোগে ব্যবহার করা হয়। পাতার রস শিশুদের চোখে দিলে চোখের যন্ত্রনার উপশম হয়।
খ) শ্বাসকষ্টজনিত রোগ যেমন- হাঁপানি ও কাশিতে ব্যবহৃত হয়।
গ) এর মূলের ছাল কারো কারো মতে গর্ভস্রাব কারক, বিরেচক, মূত্রকারক ও বিষদোষ নাশক।
ঘ) খেলে শ্লেষ্মা বেরিয়ে গিয়ে যন্ত্রনাটা কমে যাবে।
ঙ) প্রায়ই বমি বমি হলে ঝিঙ্গার পাকা বীজ ৩/৪ টা নিয়ে বেটে ১কাপ পানিতে গুলে খেলে উপকার পাওয়া যায়।
চ) দাদ চিকিতসায় ঝিঙ্গে পাতার রস এক দেড় চামচ প্রতিদিন সকালে ও বিকালে একটু পানি মিশিয়ে খেতে হবে আর রোগ যেখানে প্রকাশ পেয়েছে সেখানে ওই পাতার রস লাগাতে হবে। এই ভাবে অন্তত ২ মাস খেতে হবে তাতে এ থেকে কিছুটা পরিত্রান পাওয়া যাবে।
ছ) অর্শের রক্ত পড়ায়, একে রক্তার্শ ও বলা হয়। রক্ত পড়ে, তার সঙ্গে যন্ত্রনা। এক্ষেত্রে ঝিঙ্গা কুচি কুচি করে কেটে রোদে শুকিয়ে গুড়ো করে নিতে হবে এবং চালুনিতে ছেকে ওই গুড়ো ১ গ্রাম ও আধ কাপ গরম পানিতে মিশিয়ে সকালে ও বিকালে দুবার করে খেতে হবে। এটা দৈব ঔষদ বলে প্রচলিত।
বীজ বপনের সময়
ফেব্রুয়ারী থেকে মার্চ মাসে বীজ বপনের উপযোগী সময়।
সার
১) ইউরিয়া
২) টিএসপি
৩) এমওপি
৪) গোবর সার
ঝিঙ্গার চাষ পদ্ধতি
ক) ঝিঙ্গার জন্য এটেল দো-আঁশ মাটি উপযোগী।
খ) ঝিঙ্গার বীজ প্রথমে একটি এয়ার টাইট কন্টেইনারে একটি ভেজা টিস্যু পেপারে বিছিয়ে দিতে হবে। পরে আর একটি টিস্যু পেপার উপরে বিছিয়ে দিয়ে হালকা পানি স্প্রে করে দিয়ে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
গ) ৪দিন পরে এই বীজগুলো অঙ্কুরোদগম শুরু হবে।
ঘ) এরপর টিস্যু থেকে এই অঙ্কুরিত বীজ ছাড়িয়ে টবের মাটিতে পুতে দিতে হবে।
ঙ) কয়েকদিন পরই দেখা যাবে ঝিঙ্গা চারা উত্তোলিত হয়েছে।
পরবর্তী পরিচর্যা
ক) সময়মতো পানি দিতে হবে।
খ) মাচা তৈরী করতে হবে যাতে ঠিকমতো চারা গাছ বেড়ে উঠতে পারে।
গ) মাঝে মাঝে মাটিতে চটা বাধে তাই নিড়ানি দিয়ে মাটি মালচিং করে দিতে হবে।
ঘ) চারা ১০-১৫ সেমি লম্বা হলে ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি ২/৩ কিস্তিতে দিতে হবে।
ফসল সংগ্রহ
প্রায় ৬০-৭৫ দিনের মধ্যে ঝিঙ্গা সংগ্রহ করা যায়।
আরও পড়ুনঃ থাই পেয়ারার চাষ ও পরিচর্যা
- খোলা লোমকূপজনিত সমস্যা সমাধানে দৈনন্দিন সবজি - May 4, 2020
- মানসিক ও শারীরিক সুস্থতায় বাগানের কার্যকারিতা - April 22, 2020
- বাসা-বাড়ি পরিষ্কার এবং জীবাণুমুক্ত রাখার উপায় - April 12, 2020