সাতকরা সিলেট অঞ্চলের একটি জনপ্রিয় ফল। ফল দেখতে চ্যাপ্টা গোলাকার, খোসা পুরু, শাঁস পরিমাণে খুব কম, টক ও তিতা। প্রতিটি ফলের গড় ওজন প্রায় ৩২৯ গ্রাম। সিলেটে সাতকরা দিয়ে মাংস রান্না করা হয়। এটি ওই অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী রান্না। সিলেটে অতিথি আপ্যায়নে সাতকরার সুনাম আছে। সাতকরা দিয়ে হরেক রকম আচার তৈরি হচ্ছে। মাংসের সাথে রান্না করলে একটি আকর্ষণীয় ঘ্রাণযুক্ত খাদ্য তৈরি হয়। মূলত সাতকরা ও গরুর পায়ের হাড় দিয়ে জনপ্রিয় খাট্টা (ঝোলযুক্ত টক) তৈরি করা হয়। এছাড়া মাংসের ভুনাও তৈরি করা হয়। ঘ্রাণের জন্য সিলেট অঞ্চলে এটির এতো কদর।
সাতকরার পূর্ণাঙ্গ নাম সাইট্রাস ম্যাক্রোপটেরা মনট্রুজ (Citrus macroptera Montrouz. Var. annamensis Tanaka) নামেই বর্তমান সময়ে গবেষকদের কাছে পরিচিত হয়ে উঠছে। প্রফেসর নেছাওর মিয়া সিলেট এম সি কলেজের একজন প্রসিদ্ধ প্রফেসর, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন সাতকরার ওপর গবেষণা করে।
প্রফেসর নেছাওর মিয়ার ভাষ্যমতে সাতকরা ভারতের আসাম অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকার ফল। সাতকরা ফল প্রথম চাষ শুরু হয় ভারতের আসাম রাজ্যে। আঠারো শতকের শুরুর দিকে এ ফলের চাষ শুরু করেন ওই এলাকার শৌখিন চাষিরা। এটি উত্তরপূর্ব অঞ্চল শেলা, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরাম, মনিপুর রাজ্যে জন্মায়। সিলেটের সীমান্ত অঞ্চল জৈন্তাপুর, বিয়ানীবাজার, গোয়াইনঘাট, শ্রীমঙ্গল অঞ্চলেও এ ফল জন্মায়। তবে এসব অঞ্চলে এখন আর সাতকরার উৎপাদন নেই। বাংলাদেশের সিলেট সীমান্ত অঞ্চলে এখন বাণিজ্যিকভাবে আর সাতকরা চাষ হচ্ছে না। বাজারে যে সাতকরা পাওয়া যায় তার প্রায় সবটাই ভারত থেকে আমদানি করা।
সাতকরার পাতা অন্য সব লেবু জাতীয় ফলের পাতার চেয়ে এতই ভিন্ন যে, একমাত্র পাতা দেখেই সাতকরা গাছ চেনা সম্ভব। পাতা সুস্পষ্টভাবে বড় দু’টি অংশে বিভক্ত। শাখার সঙ্গে যুক্ত একটি অংশ। একমাত্র সাতকরার প্রথম অংশটি বড়। যা অন্য কোনো সাইট্রাস বা লেবু জাতীয় ফলে দেখা যায় না। তাই সাতকরা গাছ একমাত্র পাতা দেখেই চেনা সম্ভব।
পুষ্টিমান
অন্যান্য টক জাতীয় ফলের মতো সাতকরায় প্রচুর ভিটামিন সি বিদ্যমান। এটি বমিনাশক, খাবারের রুচি বাড়ায় ও হজমে সহায়তা করে। এর প্রাকৃতির ফ্লেভার বা সুগন্ধি বেশ আকর্ষণীয়। এর মধ্যে ২৫টি উপাদান আছে।
জাত
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট এর আবিষ্কৃত উন্নত উচ্চফলনশীল জাত হল বারি সাতকরা – ১। এটি ২০০৪ সালে উদ্ভাবিত হয়। এই জাতের গাছ মাঝারী আকৃতির, মধ্যম ঝড়ানো ও ঝোপালো হয়ে থাকে। চৈত্র-বৈশাখ মাসে গাছে ফুল আসে। শরৎকালে এর ফল পাকতে শুরু করে। এই ফল গড়ে আকারে ৩৩০ গ্রাম হয়ে থাকে। পাকা ফল হালকা হলদেটে। এটি সিলেট ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামে চাষ উপযোগী।
বংশবিস্তার
কমলার মতোই এটি কলম ও বীজ দুইভাবেই বংশ বিস্তার করা সম্ভব। মুলত জোড়কলম ও কুঁড়ি সংযোজন বা টি-বাডিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। সাতকরার জোড়কলম করার নিয়ম পর্বে এই সম্বন্ধে বিস্তারিত বলা রয়েছে।।
জলবায়ু ও মাটি
পাহাড়ি অঞ্চল সাতকরার স্বর্গভূমি বলা চলে। যথেষ্ট বৃষ্টি হয় এমন উচু পাহাড়ি অঞ্চলে সাতকরা চাষের জন্যে উপযোগী। উর্বর ও সুনিষ্কাশন ক্ষমতাসম্পন্ন বেলে-দোআঁশ মাটিতে সাতকরা চাষ করা হয়। গড়ে ১৫০-২৫০ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত ও ২৫-৩০°সেন্টিগ্রেড তাওপমাত্রা সাতকরা চাষের জন্যে উত্তম। সেই হিসেবে সিলেট বিভাগ ও চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি অঞ্চলসমূহ সাতকরা চাষের জন্যে সেরা।
জমি তৈরি
জমি তৈরির পূর্বে ভালভাবে আগের ফসল স্তূপাংশ, আগাছা পরিষ্কার করে নিতে হবে। পাহাড়ি অঞ্চলে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে মাটি ওলটপালট করে জমি তৈরি করতে হয়। সমতলভূমিতে আড়াআড়ি ও মই দিয়ে চাষ করে নিতে হবে। পাহাড়ে সিড়ি করে সাতকরার চারা লাগাতে হয়। অথবা নির্দিষ্ট দূরে দূরে গোলাকৃতি বেড তৈরি করে গাছ লাগানো যেতে পারে।
চারা রোপন ও পরিচর্যা
বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য ও ভাদ্র-আশ্বিন মাস সাতকরার চারা রোপনের উপযুক্ত সময়। গর্ত করতে হবে ৭৫ সেমি x ৭৫ সেমি x ৭৫ সেমি আকৃতিতে। চারা লাগানোর ১৫-২০ দিন পূর্বেই গর্ত করে নিতে হবে। প্রতি গর্তে ১৫ কেজি কম্পোস্ট, ৩-৫ কেজি ছাই, ৫০০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম এমওপি ও ২৫০ গ্রাম চুন দিয়ে ভালোভাবে মাটিতে মিশিয়ে নিতে হবে। গর্ত ভরাট হলে পানি সেচ দিতে হবে। সার প্রয়োগের ১০-১৫ দিন পর চারা রোপন করতে হবে। চারা রোপন করেই খুটি দিয়ে ঢেস দিয়ে দিতে হবে। আরও জানুন সম্ভাবনাময় ব্রাসেলস স্প্রাউট।
সার প্রয়োগ
সাতকরার জন্যে প্রতি বছর পঁচা গোবর, ইউরিয়া, টিএসপি এবং এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সারের পরিমাণও বাড়বে।
১-২ বছর বয়সী গাছ –
গোবর ৭-১০ কেজি
ইউরিয়া ১৭৫-২২৫ গ্রাম
টিএসপি ৮০-৯০ গ্রাম
এমওপি ১৪০-১৬০ গ্রাম
৩-৪ বছর বয়সী গাছ –
গোবর ১০-১৫ কেজি
ইউরিয়া ২৭০-৩০০ গ্রাম
টিএসপি ১৪০-১৭০ গ্রাম
এমওপি ৪০০-৫০০ গ্রাম
৫-১০ বছর বয়সী গাছ –
গোবর ২০-২৫ কেজি
ইউরিয়া ৫০০-৬০০ গ্রাম
টিএসপি ৪০০-৪৫০ গ্রাম
এমওপি ৫০০-৫৫০ গ্রাম
১০ বছর+ বয়সী গাছ –
গোবর ২৫-৩০ কেজি
ইউরিয়া ৬০০-৭০০ গ্রাম
টিএসপি ৪৫০-৫০০ গ্রাম
এমওপি ৬০০-৬৮০ গ্রাম
সার প্রয়োগের নিয়ম
ভালোভাবে গাছের চারপাশে ছড়িয়ে দিতে হবে। মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। উল্লেখিত পরিমাণ সার প্রতি বছর তিন কিস্তিতে ফেব্রুয়ারি, মে ও অক্টোবর মাসে প্রয়োগ করতে হবে।
পানি সেচ ও নিষ্কাশন
খরার সময় ২-৩ বার সেচ দিতে হবে। এতে সাতকরার ফলন ও গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে। গাছের গোড়ায় পানি জমতে দেওয়া যাবে না। এতে ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। পাশে নালা খনন করতে হবে যেন নালার মাধ্যমে পানি বেরিয়ে যেতে পারে।
ডাল ছাঁটাই ও আগাছা দমন
অঙ্গজ পদ্ধতিতে তৈরি চারার কুশি ভেঙ্গে দিতে হবে। গাছের ১-২ মিটার পর্যন্ত ডাল রাখা যাবে না। গাছের ডাল মুকুলপ্রান্ত থেকে ছেটে গাছকে ছোট রাখতে হবে। গাছের ৪-৫ টির বেশি শাখা-প্রশাখা বাড়তে দেওয়া যাবে না। রোগাক্রান্ত ডাল ছেঁটে দিতে হবে। ডাল ছাঁটাই স্থানে বুর্ডেক্স পেস্টের প্রলেপ দিয়ে দিতে হবে। বর্ষার শুরুতে ও শেষে কোদাল দিয়ে গাছের চারিপাশ হালকা কুপিয়ে আগাছা দমন করতে হবে। আরও পড়ুন সাতকরা ও লেবুজাতীয় ফলের পোকামাকড় ও রোগবালাই প্রতিকার।
ফল সংগ্রহ
হালকা সবুজ বর্ণ ধারণ ও খোসা মসৃণ অবস্থায় সাতকরা পরিপক্কতা লাভ করে। ফলগুলো আঘাত ছাড়া সংগ্রহ করতে হবে। ফল সংগ্রহের জন্যে হারভেস্টার উত্তম।
- বাংলাদেশে পঙ্গপাল আক্রমণের সম্ভাবনা - July 10, 2020
- রকমেলন চাষ ও এর পরিচর্যা - July 6, 2020
- ঘরোয়া উদ্ভিদের রোগ-বালাই নিয়ন্ত্রণ – দ্বিতীয় পর্ব - July 3, 2020