বাংলায় সাঁচি কুমড়া, চুণা কুমড়া, সাদা কুমড়া, গিমি কুমড়া, ডিমি কুমড়া প্রভৃতি নামে পরিচিত হলেও তবে বাংলাদেশে চাল কুমড়া বা জালি কুমড়া হিসেবে জনপ্রিয়। উদ্ভিদতত্ত্বিক নাম Benincasa cerifera। কুমড়া এক ধরণের কোমল কান্ডবিশিষ্ট বর্ষজীবী লতানো উদ্ভিদ। এর কান্ড দৃঢ় হালকা, সবুজ, লোমে আবৃত। চাল কুমড়ার ফল কিছুটা লম্বাটে গোলাকার।
এটি কচি অবস্থায় তীক্ষ্ণ লোমে আবৃত হলেও বড় হওয়ার সাথে সাথে লোম ঝরে পড়ে এবং আলাদা মোমের একটা আস্তরণ সৃষ্টি হয়।
ইতিহাস
চাল কুমড়া সম্ভবত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কোনো স্থানে উৎপত্তি হয়েছে। প্রাচীন কাল থেকেই এই অঞ্চলে চাষ হয়ে আসছে। প্রাচীন ভারতীয় ও চীনা সাহিত্যে এর উল্লেখ আছে। এছাড়া ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের জঙ্গলে চাল কুমড়া জন্মে থাকে।
চালকুমড়ার স্বাস্থ্য-উপকারিতা
চাল কুমড়ার উপকারিতা বলে শেষ করা সম্ভব নয়। এটি একটি পুষ্টিকর সবজি এতে বিভিন্ন ধরণের ভিটামিন, মিনারেল, শর্করা ও ফাইবার রয়েছে। চাল কুমড়ার নানাবিধ উপকারিতার মধ্যে কিছু উল্লেখ করা হল-
ক) চাল কুমড়া এন্টি মাইক্রোবিয়াল এজেন্ট হিসাবে পেট এবং অন্ত্রের ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া দূর করতে সাহায্য করে।
খ) চাল কুমড়া মানসিক রোগীদের জন্য পথ্য হিসেবে কাজ করে, কারন এটি ব্রেইন এর নার্ভ ঠাণ্ডা রাখে। এই জন্য চাল কুমড়াকে ব্রেইন ফুড বলা হয়। হিস্টিরিয়া রোগ উপশম করে।
গ) প্রতিদিন চাল কুমড়ার রস খেলে যক্ষ্মা রোগের উপসর্গ কমায়।
ঘ) চাল কুমড়া শরীরের ওজন ও মেদ কমাতে অনেক উপকারি একটি সবজি।
মুখের ত্বক এবং চুলের যত্নেও চাল কুমড়ার রস অনেক সাহায্য করে। চাল কুমড়ার রস নিয়মিত চুল ও ত্বকে মাখলে চুল চকচকে হয় এবং ত্বক সুন্দর হয়, বয়সের ছাপ প্রতিরোধ করতেও চাল কুমড়া সাহায্য করে।
ঙ) চাল কুমড়ার বীজ গ্যাস্ট্রিক রোগের উপশম করে। কোষ্ঠকাঠিন্য, পেট ফাঁপা এবং প্রস্রাব কোন কারণে অনিয়মিত হয়ে গেলে চাল কুমড়া খেলে অনেক উপকার হয়।
চালকুমড়ার ব্যবহার
কচি অবস্থায় সবজিরূপে এবং পাকা অবস্থায় মোরব্বা, হালুয়া ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
চালকুমড়ার জাত
বাংলাদেশে দুই ধরণের কুমড়া দেখা যায়।
ক) ডিম্বাকার জাত
খ) লম্বাটে জাত
এছাড়াও কিছু গুরুত্বপূর্ণ জাত রয়েছে যেগুলোর চাষাবাদ করা হয়।
১) হাইব্রীড চালকুমড়া – হীরা – ৪৫
২) উফ্শী চালকুমড়া
৩) চালকুমড়া ভৈরবী
৪) জুপিটার এফ ১
৫) পোলস্টার এফ ১
৬) দূরন্ত
উপযুক্ত সময়
কুমড়া খরিফ মৌসুমের সবজি। সাধারণত মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত বীজ বপন করা হয়।
চালকুমড়া চাষ পদ্ধতি
বাড়ির আঙ্গিনায় বা উঠোনে অথবা বাড়ির ছাদে এই কুমড়ার চাষ করা যায়। আমাদের দেশে প্রায় সবধরণের মাটিতে চাল কুমড়ার চাষ করা যায়। তবে দো-আঁশ ও এটেল দো-আঁশ মাটিতে কুমড়ার চাষ করা যায়। কুমড়া চাষের জন্য মাঝারি অথবা বড় সাইজের মাটির টব ব্যবহার করা হয় এছাড়াও হাফ সাইজের ড্রাম ব্যবহার করা যেতে পারে।
কুমড়ার চারা লাগানোর ক্ষেত্রে প্রতিটি পাত্রে ৫-৬ টি করে বীজ বপন করতে হবে। এরপর যখন বীজ থেকে চারা উৎপাদিত হবে তখন প্রতিটি টবে সবল সুস্থ্য চারা রেখে দুর্বল চারা উপড়ে ফেলতে হবে। চারা গজানোর পর প্রথম দিকে নিয়মিত পানি দিতে হবে এবং পরবর্তীতে অতিরিক্ত গরম পড়লে বেশী পানি দিতে হবে। শীতকালীন চাষের সময় জমিতে রসের পরিমাণ কম থাকলে প্রয়োজনে জমি চাষের আগে সেচ দিয়ে নিতে হবে।
চালকুমড়ার যত্ন-আত্তি
যেহেতু কুমড়া বর্ষজীবী লতানো উদ্ভিদ তাই কুমড়ার গাছের চারা একটু বড় হলে একটা ছোট লাঠি অথবা বাঁশ দিয়ে গাছকে বেঁধে দিতে হবে। এরপর যত্ন সহকারে মাচা তৈরি করে দিতে হবে। খেয়াল রাখবেন কুমড়া গাছে ফুল ধরার সময় হলে প্রথমে গাছে প্রচুর পরিমাণে পুরুষ ফুল আসে। পাশাপাশি স্ত্রী ফুলও জন্মায়। কুমড়ার পরাগায়ন সাধারণত কীটপতঙ্গ ও মৌমাছির দ্বারা সম্পন্ন হয়। কিন্তু যদি মৌমাছি দ্বারা পরাগায়ন না হয় তাহলে নিজেই পরাগয়ন করে দেয়া যায়। এক্ষেত্রে যা করতে হবে- পুরুষ ফুলের পরাগধানীতে পরাগরেণু স্ত্রী ফুলের গর্ভমুন্ডে স্থানান্তরিত হতে হবে এবং তাতেই ফল ধারণ করবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে পরাগায়ন যেন সঠিক ভাবে হয়।
চালকুমড়ার ফলনে প্রয়োজনীয় সার
কুমড়া গাছে সবসময় বাড়িতে তৈরি জৈব সার দেয়া উচিত। যেমন তরকারীর খোসা, ময়লা আবর্জনা, হাস-মুরগীর বিষ্ঠা, কাঠ-কয়লা-ছাই ইত্যাদি। এছাড়াও অজৈব সার হিসেবে ইউরিয়া, টিএসপি, মিউরেট অব পটাশ, জিপসাম, জিংক অক্সাইড ইত্যাদি দেয়া যায়।
চালকুমড়ার পোকা ও এর দমন
ফলের মাছি পোকা – এ পোকার লার্ভা ফল ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে ভিতরের অংশ খেয়ে ফেলে।
লাল কুমড়া বিটল – এ পোকা চারা গাছের জন্য ক্ষতিকর।
ইপিল্যাকনা বিটল – পাতার সবুজ অংশ খেয়ে শুধু পাতার শিরা বাদ রেখে দেয়।ফলে গাছের পাতা শুকিয়ে মরে যায়।
লাল মাকড় – এক ধরণের ছোট মাকড় যা পাতার নিচে থাকে এবং পাতার সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে।
পোকা দমনের জন্য সেভিন কিংবা নেক্সিয়ন এবং ডায়াজিনন এর স্প্রে করা হয়।
কুমড়া চাষের অন্যতম প্রধান শত্রু “মাছি”। চালকুমড়ার ফুলে ও ফলে এই পোকা বসলে ফল লাল হয়ে নষ্ট হয়ে যায়। ফলে কুমড়া ঝড়ে পড়ে। এই পোকার আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য সেক্স ফেরোমন ব্যবহার করা হয়, পোকা দেখা মাত্র মেরে ফেলা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ করা, পোকা মারার ফাঁদ তৈরি করা এবং বিষটোপ ব্যবহার করা।
চালকুমড়ার রোগ ও এর দমন
পাউডারি মিলডিউ – পাতার উপর সাদা পাউডারের মতো দেখা যায় যা পাতা নষ্ট করে দেয়। এর জন্য সুক্ষ্ণ গন্ধক চূর্ণ ডাষ্টিং, ফার্মেট স্প্রে অথবা কিউপ্রাসাইড, ক্যারাথেন প্রভৃতি ব্যবহার করা হয়।
ডাউনি মিলডিউ – পাতার নিচে ধূসর বেগুনী রং ধারণ করে ফলে গাছ দূর্বল হয়ে মরে যায়। এর জন্য বোর্দো – মিক্সচার স্প্রে কিংবা এক ভাগ তুতেঁ ও চার ভাগ চূণাযুক্ত ডাষ্ট ব্যবহার করা যেতে পারে।
ফসল সংগ্রহ
বীজ বপণের ২-৩ মাসের পর থেকে ফসল সংগ্রহ শুরু করা যায়। চালকুমড়া সবজি হিসেবে খেতে হলে সবুজ হুল যুক্ত ৪০০-৬০০ গ্রাম হলে তুলতে হবে। মোরব্বা বা বড়ি দেওয়ার জন্য পরিপক্ক করে ১২০-১৩০ দিন পর তুলতে হবে।
- খোলা লোমকূপজনিত সমস্যা সমাধানে দৈনন্দিন সবজি - May 4, 2020
- মানসিক ও শারীরিক সুস্থতায় বাগানের কার্যকারিতা - April 22, 2020
- বাসা-বাড়ি পরিষ্কার এবং জীবাণুমুক্ত রাখার উপায় - April 12, 2020