আপনি জানেন কি মানিপ্ল্যান্ট উদ্ভিদের গুনাগুণ সম্বন্ধে? কিংবা জানলেও এটি জানেন কি কিভাবে এদের বড় করবেন আপনার বাড়ির আঙিনায়?
আসুন এসকল তথ্য জেনে নিন আজকের এই আর্টিকেলের মাধ্যমে! আমরা আপনাকে মানিপ্ল্যান্ট সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিয়ে সহায়তা করব! এই আর্টিকেল পড়লে আপনি জানবেন কিভাবে মানিপ্ল্যান্ট উদ্ভিদ পটিং করবেন, এর যত্ন-আত্তি ও গুনাগুণসমূহ।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা জানিয়েছে যে ১০ টি বায়ু শোধনকারী উদ্ভিদ। এর মধ্যে মানিপ্ল্যান্ট উদ্ভিদ অন্যতম কারণ এটি বায়ুমণ্ডলে থাকা বিষাক্ত পদার্থ নষ্ট করে ফেলে। এছাড়াও এটি সুপ্রসন্ন ভাগ্যর চিহ্ন হিসেবে পরিচিত। এটি বিশ্বাস করা হয় যে, যে ঘরে মানিপ্ল্যান্ট আছে সে ঘরের সম্পদ বৃদ্ধি পায়। তাই অনেকে এটি ঘরের টবে লাগিয়ে রাখেন।
আপনি যদি অনলাইন থেকে মানিপ্ল্যান্ট উদ্ভিদ কিনতে চান তবে অনেক খরচ করতে হবে কিন্তু মানিপ্ল্যান্ট উদ্ভিদ এর বীজ বপন কিংবা প্রতিবেশীর গাছ হতে কিছু অংশ তুলে নিয়ে রোপণ করলেও গজাবে!
যখনি আপনি মানিপ্ল্যান্ট উদ্ভিদ লাগাবেন তখনি এর জন্য উপযুক্ত পরিবেশে এর যত্ন-আত্তি শুরু করতে পারেন। এরা এতোই ঘরোয়া যে এদের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য কোনপ্রকার সার লাগবে না!
কৃষকেরা মানিপ্ল্যান্ট উদ্ভিদ বায়ু পরিষ্কারক হিসেবে চাষ করেন। ব্যবসায়ে অত্যাধিক লাভ এর আশায় বাড়িতে, অফিসে, বিপণন কেন্দ্র গুলোতে মানিপ্ল্যান্ট রাখা হয়। আপনি যদি এর সঠিক উপায় যত্ন সম্পর্কে জানেন তবে খুব সহজেই এর যত্ন-আত্তি নিতে পারবেন।
মানিপ্ল্যান্ট গুড লাক ট্রি, সিলভার ভাইন, ত্যারো ভাইন, হান্টারস রোব, সোলোমন আইল্যান্ড আইভি এবং ডেভিলস আইভি নামে পরিচিত।
Araceae পরিবারের গাছ হল এই মানিপ্ল্যান্ট।এরা নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার সাথে বেশ ভালো খাপ খাইয়ে নিতে পারে। এছাড়াও বর্তমানে আমাদের দেশের আবহাওয়ার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারছে।
আংশিক ছায়াযুক্ত স্থানে কিংবা প্রখর রৌদ্রে কি ঘরে কি বাইরে সকল পরিবেশে এরা বেশ সহজেই বড় হয়। ঘরোয়া মানিপ্ল্যান্ট গুলো ২/৩ ফিট উঁচু হয় যেগুলোর এরিয়েল মূল আছে। পাতাগুলো হৃদয়াকৃতির হয়ে থাকে (সাদা, হলুদ বা হালকা সবুজ রঙ)
মানিপ্ল্যান্ট এর জাত
মানিপ্ল্যান্ট এর জাত এর বৃদ্ধির হার, গঠন ও চাষের পরিবেশ দেখে নির্বাচন করা হয়।
জাতের নাম | ধরণ |
---|---|
Epipremnum aureum | ক্রান্তীয় লতা উদ্ভিদ |
Lunaria annua | দ্বিবার্ষিক ঔষধি উদ্ভিদ |
Crassula ovata | মাংসল পাতাযুক্ত ছোট উদ্ভিদ |
Pachira aquatica | ক্রান্তীয় জলাভূমি গাছ |
Pilea peperomioides | গাঢ় সবুজ রঙের গোলাকার পাতাযুক্ত ছোট উদ্ভিদ |
বীজের মাধ্যমে মানিপ্ল্যান্ট উদ্ভিদ রোপণ
উদ্ভিদ | মানি প্লান্ট |
উৎপত্তিস্থল | ক্রান্তীয় অঞ্চল |
পরিবার | Araceae |
সায়েন্টিফিক নাম | Epipremnum aureum |
মাটির প্রকৃতি | নিরপেক্ষ মাটি,পিএইচ ৬ হতে ৭.৫ |
ফুল | গোলাপি, হালকা বেগুনি, সাদা রং |
সূর্যালোক | আংশিক |
উপযুক্ত তাপমাত্রা | ৭২ ফারেনহাইট |
উদ্ভিদের উচ্চতা | ৩-৬ ফিট |
সার | NPK সার |
বীজের জাত নির্বাচন
মানিপ্ল্যান্ট উদ্ভিদের বীজ বাজার থেকে কিনে পটে লাগাবেন। এছাড়াও আপনার বন্ধুদের থেকে কিংবা আপনার প্রতিবেশীর কাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে পারবেন.বীজ বপন করার আগে খেয়াল রাখতে হবে যে বীজগুলো যেন ভেজা না হয়, পুরোপুরি শুকনো ও পরিষ্কার হতে হবে। পরিষ্কার করার জন্য উষ্ণ তোয়ালে ব্যবহার করতে হবে। এরপর বীজ পট কিংবা কন্টেইনারে বপন করুন।
মাটি এবং পাত্র নির্বাচন
এমন একটি পট নির্বাচন করুন যাতে মানিপ্ল্যান্ট হেলে পড়ে না যায়। ঘরোয়া উপায়ে মানিপ্ল্যান্ট লাগাতে চাইলে ৬ ইঞ্চির একটি পট নিন। শুরুতে আপনি চাইলে মাটি, সিরামিক বা প্লাস্টিকের পট নিতে পারেন। পরবর্তীতে যখন গাছটি বড় হবে ও তখন বড় পট ব্যবহার করবেন।
Epipremnum aureum গাছটি সাধারনত নিরপেক্ষ পিএইচ এর মাটি পছন্দ করে যার রেঞ্জ ৬-৭.৫ এর মধ্যে হয়। খুবই অল্প সংখ্যক গাছ ৯-১১ পিএইচ এর মাটিতে টিকে থাকতে পারে।আপনি চাইলে অধিক পরিমাণে পটিং মাটি মিশিয়ে নিতে পারেন যাতে পাট মস বা পারলাইটের পরিমাণ বেশি থাকে।
মানিপ্ল্যান্টে পানি দেয়ার নিয়ম
যখনি গাছের সামান্য উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে তখনি প্রতিদিন অল্প পরিমাণে গাছে পানি দিন। যখন গাছটি বড় হবে তখন প্রতি সপ্তাহে ২/৩ ইঞ্চি পানি শোষণ করতে পারে যখন মাটি পুরোপুরি শুকনো থাকে।
গাছ দ্রুত বৃদ্ধি হয় যদি আপনি ঘরের তাপমাত্রায় এটিকে রাখতে পারেন। মানিপ্ল্যান্ট ঠান্ডা আবহাওয়ার চেয়ে গরম আবহাওয়া বেশি সহ্য করতে পারে। ঘরোয়া মানিপ্ল্যান্ট এর জন্য ৭২ফারেনহাইট হল উপযুক্ত তাপমাত্রা। যদি তাপমাত্রা ৫৫ ফারেনহাইটের নিচে নেমে যায় তবে গাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়।
পোকা-মাকড় ও রোগ বালাই
পোকা | রোগ বালাই |
---|---|
স্কেল | পাউডার মিলডিউ |
মাকড়সা পোকা | নেতিয়ে পড়া |
মিলি বাগ | ধূসর ঘন রঙের চিতই পড়া |
সাদা মাছি | গোড়া পচা |
জাব পোকা | ঢলে পড়া, নির্জীব |
থ্রিপস | পাতায় পচন ধরা |
ছত্রাক জনিত নাটস | পাতার চূড়ায় হলুদাভ রং |
পুষ্টি জনিত ঘাটতি
সিরিয়াল | উপাদান | ঘাটতির লক্ষণ |
---|---|---|
১ | ক্যালসিয়াম | পাতা কুঁকড়ে হুকের মত হয়ে যায়,পাতার চূড়া মারা যায়। |
২ | নাইট্রোজেন | পাতা বুড়িয়ে যায়, ফলিয়েজ হালকা সবুজ, হলুদ কান্ড। |
৩ | ম্যাগনেসিয়াম | ধীর গতিতে বৃদ্ধি হয়,হালকা হলুদ পাতা, পাতায় গাড় দাগ পড়ে। |
৪ | ফসফরাস | ছোট পাতা,লালাভ বেগুনি রঙের ছাপ, বয়স্ক পাতা কালো হয়ে যায়। |
৫ | পটাশিয়াম | পাতায় পোড়া ভাব, পাতার শিরার মাঝে হলুদ হয়ে যায়। |
৬ | সালফার | ধীর গতিতে বৃদ্ধি, হালকা হলুদ রঙের পাতা। |
কিছু বিষয় আছে সে জন্য মানিপ্ল্যান্ট উদ্ভিদের বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমনঃ পর্যাপ্ত পরিমাণে সূর্যালোক না পাওয়া, কম বা বেশি পানি দেয়া, খনিজ পদার্থের ঘাটতি ইত্যাদির জন্য গাছে পাতা হলুদ হয়ে যায়, পাতা অকালে ঝরে পড়ে যায়, পাতার চূড়ায় বাদামী রঙ হয় ]। এসব সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে ভাল জৈব সার ব্যবহার করতে হবে। এছাড়াও পাতাকে নিমের তেল দিয়ে মুছে দিতে হবে।
গাছ কাটছাঁট করা এবং পুনরায় পটিং করা
মানিপ্ল্যান্ট উদ্ভিদ কাটছাঁট করার উপযুক্ত সময় হল শীতকাল, তবে এটি করা আসলে খুব একটা জরুরী না! আপনি যদি দুর্বল ও ছোট পাতা ছেঁটে ফেলে নতুন সতেজ পাতা গজাতে চান তবে বছরে একবার না করে, যেকোনো সময় কাটছাঁট করতে পারেন ।
বসন্ত কিংবা গ্রীষ্মে গাছকে পুনরায় পটিং করুন কারন এ সময়ে গাছ খুবই দ্রুত বৃদ্ধি পায়। যেহেতু গাছ প্রতি বছর বড় হয় তাই আপনাকে প্রতি বছরই বড় পটে স্থানান্তর করতে হবে।
সার প্রয়োগ
বসন্ত ও গ্রীষ্মে প্রতি ২ সপ্তাহে একবার সার প্রয়োগ করতে হবে। মানিপ্ল্যান্ট এর বৃদ্ধির হার একে যে পটে রাখা হয় সে পটের আকৃতির উপর নির্ভর করে। এছাড়াও তরল NPK সার, জৈব সার বা গোবর দিতে পারেন। তবে ডিমের খোসা, ইপসম লবণ এবং বেকিং সোডা এর বৃদ্ধির জন্য খুবই উপকারী ।
কখনোই এর বৃদ্ধির সময় ব্যতীত সার প্রয়োগ করবেন না এতে করে হিতে বিপরীত হতে পারে। গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। সঠিক পরিমাণে ও সঠিক সময়ে সার প্রয়োগ করতে হবে।
কিভাবে মানিপ্ল্যান্ট উদ্ভিদের অঙ্গজ প্রজনন করা যায়?
কান্ড কেটে লাগালে নতুন মানিপ্ল্যান্ট উদ্ভিদ পাওয়া যায় যা বীজের সাহায্যে উদ্ভিদ জন্মের তুলনায় সহজ। মাটিতে যেকোনো স্থানে লাগানো যায়।
পানিতে মানিপ্ল্যান্ট উদ্ভিদের বৃদ্ধি যেভাবে করবেন
একটি ২০-৩০ সেমি কান্ড যেখানে পাতা গজায় সেখানে ৪৫° কোণে কেটে নিন। শাখাটিতে কমপক্ষে তিনটি নোড অবশ্যই আছে কিনা দেখে নিন।
এক গ্লাস বা জারের পানিতে কাটা কান্ড রেখে দিন। নূন্যতম একটি কান্ড পানিতে ডুবে আছে কিনা দেখে নিন।জারটিকে জানালার কাছাকাছি রাখুন যাতে কমপক্ষে ছয় ঘন্টা সূর্যালোক পায়। কিছু সপ্তাহের মধ্যেই নতুন মূল গজাবে ও বৃদ্ধি পাবে।
পাত্রের পানি সপ্তাহে একবার বা দুইবার বদল করবেন।
যদি আপনি সার ব্যবহার করতে চান তাহলে তরল নাইট্রোজেন সার ব্যবহার করতে পারেন, এটি পানিতে জন্মানো মানিপ্ল্যান্ট এর জন্য খুবই উপকারী।
যেভাবে মাটিতে মানিপ্ল্যান্ট বড় করবেন
পানি ছাড়াই গাছের মূলের সাহায্যে মাটিতে মানিপ্ল্যান্ট চাষ করতে পারেন। অধিকাংশ মানুষ এই পদ্ধতিকে অধিক উপযুক্ত মনে করেন।
মাটিতে চাষ করার পদ্ধতি
স্বাস্থ্যবান কান্ড নিন যার উচ্চতা ২০-৩০ সেমি হয়, যেন ঘরের বাইরে ভালোমত জন্মাতে পারে। সহজেই পানি নিষ্কাশন করতে পারে এমন মাটিতে কান্ডের অংশ লাগান। বালি, ক্লে বা পটিং মাটিও মিশিয়ে নিতে পারেন। যতদিন না পর্যন্ত মূল পরিপূর্ণ হবে আর গাছ দ্রুত বৃদ্ধি না পায় ততদিন পর্যন্ত পানি দিয়ে যাবেন। ২ বার সফলভাবে পানি দেয়ার মধ্যবর্তী সময়ে মাটি শুকাতে সময় দিন। তবে মাত্রাতিরিক্ত পানি দিবেন না এতে করে গাছের পাতা হলুদ হয়ে যায়, কুঁকড়ে যাওয়া সহ আরো সমস্যা দেখা দেয়। মাটির ধরন বুঝে পরিমিত পরিমাণে সার ব্যবহার করতে হবে।
মানিপ্ল্যান্টের যত্ন-আত্তি
২-৩ বছর পর পর পাত্র বদলাবেন। আগাছা ছেঁটে দিলে গাছ সুন্দর দেখাবে। শীতকালে গাছের অধিক পরিমাণে পানি দরকার নেই তাই কম পানি দিলেও চলবে। গাছ শুকিয়ে গেলে গাছের গোড়ায় ভিজে খড়,পাতা দিবেন ।গাছকে যতোটা সম্ভব সূর্যালোকের কাছে রাখতে হবে। তবে অত্যাধিক গরম বা ঠান্ডা পরিবেশে রাখা যাবে না।
গাছের বৃদ্ধির সাথে সাথে গাছকে বড় পাত্রে স্থানান্তর করবেন।
মানিপ্ল্যান্ট কি ফুল দেয়?
মানিপ্ল্যান্ট একটি দ্বিবার্ষিক ফুলের উদ্ভিদ । সাদা সিলভার রঙের বীজশুটিঁ চ্যাপ্টা আকৃতি ধারণ করে। বসন্তে ও গ্রীষ্মে বেগুনি রঙের ফুল হয় ।
কিভাবে মানিপ্ল্যান্টের বীজ সংগ্রহ করব?
যখনি বীজের শুটি শুকায়া যাবে মানিপ্ল্যান্ট, সংগ্রহ করুন। বীজশুটি গুলো গাছ থেকে সংগ্রহ করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুকাতে দিন। এরপর শুকনো বীজের শুটি থেকে সমতল আকৃতির বীজ সংগ্রহ করুন। ঠান্ডা ও শুকনো পরিবেশে বীজগুলো সংগ্রহ করুন্
মানিপ্ল্যান্ট গাছের পাতা হলুদ হয় কেন?
১) প্রখর সূর্যালোকে
২) অধিক বা প্রয়োজনের তুলনায় কম পানি দিলে
৩) দিনে ও রাতে তাপমাত্রার ঘনঘন পরিবর্তনে
৪) পুষ্টির অভাবে।
মানিপ্ল্যান্ট কি পোষা প্রাণীর জন্য বিষাক্ত?
মোটেও না! তবে কিছু সামান্য ধরনের পেটের হজমজনিত সমস্যা হয়, ঠান্ডা লাগতে পারে, এলার্জি, বমি হতে পারে। তাই গাছকে পোষা কুকুর ও বিড়াল থেকে দূরে রাখতে হবে।
মানিপ্ল্যান্ট বাতাস থেকে বিষাক্ত পদার্থ শোষণ করে নেয়। তাই ঘরের সৌন্দর্য বর্ধনের পাশাপাশি ঘরের বায়ু পরিষ্কারক হিসেবে রোপণ করুন।
- জেনে নিন গোল মরিচের ১০ টি চমৎকার উপকারিতা - September 11, 2020
- মালবেরি বা তুঁত চাষ পদ্ধতি - May 23, 2020
- ছাদবাগানে আম চাষ – আম গাছের জোড় কলম পদ্ধতি - March 20, 2020
Comments 1