এখন চলছে মধু মাস। এই সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে সেরা ফলগুলো পাওয়া যায়। আম, জাম, , কাঁঠাল, লিচু সহ আরও অনেক দারুণ দারুণ ফল। একেক ফলের জন্যে একেক অঞ্চল প্রসিদ্ধ। সেইসব অঞ্চলে তখন ফল কেনা-বেচার ধুম পড়ে যায়। মানুষ চায় প্রসিদ্ধ অঞ্চলের সেরা ফলটি খেতে। তেমনি ফলের রাজা আমের জন্যে প্রসিদ্ধ হল উত্তরবঙ্গ। রাজশাহী, রংপুর, চাপাইনবাবগঞ্জ এর সেরা সেরা আমগুলো খেতে কে না চায়!
আমের ভরপুর এই সিজনে ঠিকভাবে আম পাড়া ও পরবর্তীকালিন সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে আমের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এছাড়া আমাদের দেশে এখনো পাকা আম দ্রুত খেয়ে ফেলা, ফ্রিজে কিছুদিন সংরক্ষণ করা, আর উৎপাদিত আমের অল্প কিছু অংশ জ্যুস করে বাজারজাত করা হয়। পাকা আম দীর্ঘমেয়াদী সংরক্ষণের তেমন কোনো সংস্কৃতি এখনো গড়ে উঠেনি।
প্রচলিত আম পাড়ার পদ্ধতি
বাণিজ্যিকভাবে আম চাষকারী উত্তরবঙ্গের বাগানীরা অধিকাংশ সময় আম বাগান ইজারাদের কাছে পাকার আগেই বিক্রি করে দেয়। আম পাড়া, আক্রা অনুযায়ী বাছাই করা, বস্তাবন্দী করা, প্যাকেজিং করা, বাজারে পাঠানো, কুরিয়ার করা থেকে শুরু করে মোটামুটি সবই ইজারাদের হাত দিয়েই হয়ে থাকে। বাজারে বিভিন্ন জাতের আম আগাম ছাড়ার জন্যে দেখা যায় সঠিক সময়ের আগেই ইজারাদাররা আম পেড়ে ফেলে। সাধারণত আম পাকার আগেই রঙ ধরা শুরু করলেই পাড়া শুরু করতে হয়। আম পুরোপুরি পাকার পর পাড়লে দ্রুত পচন ধরার সম্ভাবনা থেকে যায়।
প্রচলিত পদ্ধতিতে গাছে উঠে আম পাড়া হয়। দুইজন নিজে গামছা বা বড় চাদর দুইপাশে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। আরেকজন গাছে উঠে আম ছিড়ে ছিড়ে নিচে ফালাতে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বড় বাঁশ বা লাঠিকে ছিপ বা কোটা বানিয়ে পাড়া হয়ে থাকে। গাছ থেকে এভাবে আম পাড়তে গেলে বোঁটা ভেঙে আমের গায়ে কষ ছড়িয়ে পড়ে। অনেক সময় যিনি আম পাড়েন, তার চোখেমুখেও কষ লাগে। ওই স্থানে ঘা হয়ে যায়। কষের কারণে আম ‘অ্যানথ্রাকনোজ’ ছত্রাকে আক্রান্ত হয়। পাকতে না-পাকতেই আম পচে যায়। বোঁটা থেকেই এর পচন শুরু হয়। আবার অনেক সময় নিচে পেতে রাখা গামছা থেকে বের হয়েও নিচে পড়ে যায়। এতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। আঘাত লাগা আম পাকার আগেই পচে যায়।
আম পাড়ার সঠিক পদ্ধতি
কয়েক বছর পূর্বে নওগাঁর এক চাষী আম পড়ার আধুনিক ঢুসী বা ম্যাঙ্গো হার্ভেস্টার উদ্ভাবন করেন। প্রচলিত আম পাড়ার ঠুসির লগির সঙ্গে একটি কাপড় লাগিয়ে সরাসরি আম নিচে নামানোর পদ্ধতি বের করেন। ঠুসির মুখে একটি কাটার যন্ত্র লাগিয়ে বোঁটার একটু ওপর থেকে কেটে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। বোঁটাসহ কাটতে পারলে কষ বের হবে না। ফলে আমে কষ লেগে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে না।
এই পদ্ধতি তেমন ব্যয়বহুল না। সাধারণ বাঁশ, বড় কাপড় ও ছোট ছুড়ি দিয়েই এটি ঘরে বসে বানানো সম্ভব। এর ফলে প্রচলিত পদ্ধতিতে আম পাড়ার ফলে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে, তা এড়ানো যাবে।
আম বাছাইকরণ পদ্ধতি
অনেক আম পাড়া হলে এই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি মেনে চলা শ্রেয়। বিভিন্ন আমের আকৃতি ও রঙ বিভিন্নরকম হয়ে থাকে। একই আকৃতির আমকে বাছাই করে আলাদা করা উচিত। এতে বাজারে দাম ভাল পাওয়া যায়। এছাড়াও আম কুরিয়ার করার সময় প্যাকেজিং করতে ব্যাপক সুবিধা হয়। বিভিন্ন জাতের আম প্যাকেজিং করতে গেলে প্যাকেজিং এর অসামাঞ্জস্যতার ফলে আম ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। এছাড়া রঙের এর চেয়ে আম কতটুকু পেকেছে, সেই অনুযায়ী প্যাকেজিং করতে হবে। হালকা জোরে আম টিপে টিপে পরখ করা যেতে পারে। কাচা পাকা আম মিক্সড করে প্যাকেজিং বা সংরক্ষণ করা হলে আম পচার হার বেড়ে যায়।
আম সংরক্ষণ
আমের অত্যাধিক উৎপাদনের ফলে এর দীর্ঘমেয়াদী ও স্বল্প মেয়াদী সংরক্ষণ করার প্রয়োজনীয়তা বেড়ে চলেছে দিন দিন। সঠিক প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করা গেলে আম অনেকদিন পর্যন্ত টাটকা থাকে।
স্বল্পমেয়াদী সংরক্ষণ ব্যবস্থা
ক) আম পাকা কিনা দেখতে হবে
স্বল্পমেয়াদী সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপেই আপনাকে জানতে হবে আমটি কেমন অবস্থায় রয়েছে। পুর্বেই বলেছি আমের রঙ দেখে কখনো এর পাকা বা কাঁচা অবস্থা নির্ধারণ করা যায় না। কাঁচা আমের দেহাংশ শক্ত, দৃঢ় ও আকর্ষণীয় গন্ধ থাকে না। অন্যদিকে পাকা আম বেশ নরম হয়ে থাকে। এভাবে আমের অবস্থা নিরূপণ করে নিতে হবে।
খ) কাঁচা আম অন্ধকার ঘরে রাখুন
আম মূলত কিছুটা কাঁচা অবস্থায়ই পাড়া হয়। আপনার হাতেও যদি কাঁচা আম পড়ে থাকে এদের পাকার জন্যে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করুন। কাঁচা আম পাকতে দেওয়ার জন্যে কোনো ঝুড়িতে রেখে অন্ধকার ঘরে রাখুন। বদ্ধ ঝুড়ি পরিহার করুন। এতে অক্সিজেন প্রবেশে বাধা পায়। যার ফলে আম সঠিক সময়ে পাকবে না। দেশীয় পদ্ধতিতে খাটের নিচে রাখা হয়। এটিও সঠিক পদ্ধতি। আলো প্রবেশ করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা রাখুন। মেঝেতে পাটের বস্তা বিছিয়ে নিন। আমের উপরে পেপার দিয়ে ঢেকে রাখুন। দুইদিন পর পর চেক করে দেখুন। সাধারণত ৮ দিনের মধ্যে আম পেকে যায়।
গ) পাকা আম ফ্রিজে সংরক্ষণ করুন
আম একসাথে পেকে গেলে কিছু আম আরও কয়দিন সংরক্ষণ করার প্রয়োজন পড়তে পারে। সাধারণত ফ্রিজে ৬ দিন পর্যন্ত আম রেখে খেতে পারেন। ফ্রিজের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট কিংবা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস হওয়া বাঞ্ছনীয়।
ঘ) পচন ধরা আম সরিয়ে ফেলুন
সাধারণত আম সংরক্ষণের এই প্রক্রিয়ায় কিছু আম নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অধিকাংশ সময় আম পাড়ার অব্যবস্থাপনার ফলে অনেক আম ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকে। আমের ৫০ ভাগের বেশি পচে গেলে অন্যান্য আম থেকে সরিয়ে ফেলুন। নইলে অন্য আমেও পচন ধরা শুরু করবে। এজন্যে নিয়মিত আম চেক করে দেখা ভাল।
আমের দীর্ঘমেয়াদী সংরক্ষণ ব্যবস্থা
ক) আমকে কিউব বা স্লাইস করে কাটুন
দীর্ঘমেয়াদী সংরক্ষণের প্রথম ধাপ হিসেবে আমকে প্যাকেজিং এর সুবিধা মত কিউব বা স্লাইস করে কেটে ফেলুন। এরপর এই আমকে একটি জিপলক স্বচ্ছ পলিব্যাগে ঢুকিয়ে ফ্রিজিং করুন। অনেকেই মনে করে আম ফ্রিজিং করে সংরক্ষণ করতে চামড়া সরিয়ে ফেলা উচিত। তবে এটি বাধ্যতামূলক না। চামড়াসহ আম ফ্রিজিং হতে একটু সময় নেয়, এইই পার্থক্য।
খ) জিপলক ব্যাগে সংরক্ষণ
জিপলক ব্যাগে সংরক্ষণের জন্যে এমনভাবে আমগুলোকে ভেতরে সাজাবেন যেন একটির উপর আরেকটি না উঠে যায়। অর্থাৎ আম দিয়ে ঠেসে ঠেসে ভরবেন না। প্যাকেটটি সিল করর পূর্বে যতটুকু বাতাস প্রবেশ করানো সম্ভব, করে নিন।
গ) জিপলক ব্যাগ ফ্রিজিং এর নিয়ম
জিপলক ব্যাগটি যেনতেন ভাবে ফ্রিজিং করলে চলবে না। ব্যাগটি ফ্রিজের কম্পার্টমেন্টে শুইয়ে দিন। এর উপরে আলতোভাবে আরেকটি ব্যাগ দিন। এভাবে সাজিয়ে সাজিয়ে রাখুন। তবে প্রেশার দেওয়া যাবে না বা আম রাখার কম্পার্টমেন্টে অন্য কিছু রাখা যাবে না।
ঘ) ৬ মাস ধরে সংরক্ষণ করুন
এইভাবে আম ৬ মাস পর্যন্ত খাওয়া সম্ভব। ভাবুন তো, শীতকালেও আপনি টাটকা আম খাচ্ছেন কিংবা জ্যুস বানাচ্ছেন! হ্যা, এটাও সম্ভব। তবে এই আম আপনার ফ্রিজিং করা অদক্ষতা কিংবা জিপলক ব্যাগে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাবে কালচে হয়ে যেতে পারে। তবে এই আমও অনায়াসেই খেতে পারবেন।
এভাবে সঠিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করে বহুদিন এই আম খেতে পারবেন। পরবর্তী পর্বে আমরা পাকা আমের বাণিজ্যিকভাবে দীর্ঘমেয়াদী সংরক্ষণ সম্বন্ধে আরও বিস্তর জানব। আর পাকা আমের নানাপদের রেসিপি জানতেও আমাদের সাথেই থাকুন।
আরও পড়ুনঃ আম রাজত্বের কিছু সম্রাটদের গল্প
- বাংলাদেশে পঙ্গপাল আক্রমণের সম্ভাবনা - July 10, 2020
- রকমেলন চাষ ও এর পরিচর্যা - July 6, 2020
- ঘরোয়া উদ্ভিদের রোগ-বালাই নিয়ন্ত্রণ – দ্বিতীয় পর্ব - July 3, 2020