আম বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় ফল। এই উপমহাদেশেই আমের শতকরা সত্তর ভাগ জন্মে থাকে। বাংলাদেশের সর্বত্র আম গাছ দেখা যায়। তবে সবচেয়ে ভাল আম পাওয়া যায় উত্তরবঙ্গে। পোপেনো(১৯৬৪) আমকে ‘প্রাচ্য দেশের ফলের রাজা’ রূপে সম্বোন্ধন করেছেন। মুঘল সম্রাট আকবর দারভাঙ্গার নিকট একটি বাগানে এক লক্ষ আম গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করে সেই স্থানের নাম দিয়েছিলেন ‘লাখ-বাগ’। কবি আমির খসরু চতুর্দশ শতাব্দীতে তার কবিতায় আমকে হিন্দুস্থানের সেরা ফল হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
ইতিহাস
কারো কারো মতে ভারত উপমহাদেশেই এর উৎপত্তি। প্রায় চার হাজার পূর্বেও আম গাছ ছিল বলে জানা যায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাংলাদেশ, আসাম, ব্রহ্মদেশ এবং মালয় এলাকা আমের পুরনো নিবাস বলে দাবী করা হয়। আলকজান্ডার ভারত আক্রমণকালে খ্রীস্টপূর্ব ২২৭ অব্দের দিকে সিন্ধু অববাহিকায়; ১৩৩১ খ্রিস্টাব্দে আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে আমগাছ দেখা গেছে। ষষ্ঠদশ শতাব্দীর মধ্যে পারস্য উপসাগরে এবং সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যে ফিলিপাইন, কুইন্সল্যান্ড, হাওয়াই প্রভৃতি স্থানে আম পৌঁছে গিয়েছিল।
আমের জাত
বাংলাদেশে আমের অনেকরকম জাতের চাষ করা হয়। সুস্বাদু আমের একমাত্র যোগানদাতাই উত্তরবঙ্গ। বিভিন্ন জাতের আমের মধ্যে পার্থক্য আকৃতি, স্বাদ ও পাকার সময়ের ভিত্তি করে করা হয়। বাংলাদেশের কয়েকটি সুপরিচিত জাতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ফজলী, ল্যাঙড়া, গোপালভোগ, কিষাণভোগ, হিমসাগর, কহিতুর, ক্ষীরসাপাতি, মোহনভোগ, শ্রীধন, বৃন্দাবনী, মালগোভা, আনোয়ার রেতাউল, ফজরীকলন, মিঠুয়া, দু-সেহরী, পিয়ারী, আলফান্সো, দুধিয়া, বোম্বাই, বারমাসী, কাঁচা মিঠা প্রভৃতি। ক্ষীরসাপাতি বাংলাদেশের জেনেটিক্যাল আমের জাত। এটি শুধু বাংলাদেশেই পাওয়া যায় এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।
ছাদে চাষ উপযোগী আমের জাত
সুস্বাদু আম শুধু উত্তরবঙ্গেই পাওয়া গেলেও এখন আমের বিভিন্ন হাইব্রীড জাত আমাদের বাসার ছাদেও চাষ করা যায়। অনেকেই শখের বসে ছাদে বড় ড্রাম বা টবে আম চাষ করে থাকেন। সব জাতের আমই ছাদে চাষ করা যায়। তবে ছাদে সবচেয়ে ভাল হয় বারি আম-৩ জাতটি। ছোট আকৃতি গাছ, মাঝারি সাইজের ফল ও খেতে বেশ সুস্বাদু। এর আরেক নাম আম্রপালি। মোটামুটি প্রতিবছরই এই জাতের আম ফলন দেয়। তাছাড়াও বাউ আম – ১, ২, ৩, ৬, ৭, লতা বোম্বাই ইত্যাদি বামন জাতের আম ছাদের জন্য বেশ উপযোগী।
টবের আকৃতি
ছাদে টবে আম চাষ করতে বিশেষ যত্ন নেওয়ার প্রয়োজন হয়। টবে আম চাষ পদ্ধতি স্বাভাবিকভাবে আম চাষের পদ্ধতির চেয়ে অনেকড়াই ভিন্ন। ছাদে তিনরকম সাইজের টবে আম চাষ সম্ভব।
১. ফেলে দেওয়া অর্ধ বা সম্পূর্ণ ড্রাম
২. সিমেন্টের তৈরি টব, যা ব্যাস ৭৫ সেন্টিমিটার ও উচ্চতা ১.২৫ মিটার
৩. ইট-সিমেন্টের তৈরি দেড় মিটার লম্বা, চওড়া ও উচ্চতা সম্পন্ন টব
মাটি তৈরির পদ্ধতি
ছাদে আমের কলমের চারা লাগানোর জন্য উপরোক্ত যেকোনো সাইজের ড্রাম বা টবে তলায় ৩-৫ টি ছিদ্র করে নিতে হবে যেন গাছের গোড়ায় পানি জমতে না পারে। পুরনো মাটির টব বা ইট ভেঙ্গে টবের তলার ছিদ্রগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। এবার ২ ভাগ দোআঁশ মাটি, ১ ভাগ গোবর, ৪০-৫০ গ্রাম টিএসপি সার, ৪০-৫০ গ্রাম পটাশ সার, ১ কেজি কাঠের ছাই, ১ কেজি মৃত প্রাণির হাড়ের গুড়া ও হাফ কেজি সরিষার খৈল একত্রে মিশিয়ে ড্রাম বা টব ভরে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। এভাবে যেতে দিতে হবে ১৫ দিন। অতঃপর মাটি ওলটপালট করে দিয়ে আরও ৪-৫ দিন এভাবেই রেখে দিতে হবে।
আরও পড়ুনঃ আমের মাজরা পোকার আক্রমণের প্রতিকার
চারা রোপন পদ্ধতি
মে-জুন মাসে চারা রোপন করা ভাল। মাটি কিছুটা ঝুরঝুরে হলে একটি সুস্থ সবল কলমের চারা উক্ত টবে রোপন করতে হবে। চারা গাছটিকে সোজা করে লাগাতে হবে। প্রয়োজনে কোনো লাঠি দিয়ে গাছের কান্ড ঠেস দিয়ে রাখতে হবে। সেই সাথে গাছের গোড়ায় মাটি কিছুটা উচু করে দিতে হবে এবং মাটি হাত দিয়ে চেপে চেপে দিতে হবে যেন গাছের গোড়া দিয়ে বেশী পানি না ঢুকতে পারে। চারা লাগানোর পর প্রথমদিকে পানি কম দিতে হয়। আস্তে আস্তে পানির পরিমাণ বাড়াতে হবে। টবের গাছটিকে এমন জায়গায় রাখতে হবে যাতে প্রায় সারাদিন রোদ লাগে।
টবে আম গাছের যত্ন ও সার প্রয়োগ
একটি সদ্য লাগানো আম গাছে বছরে দুইবার সার প্রয়োগ করতে হয়। প্রথমবার জুন মাসে এবং দ্বিতীয় বার অক্টোবর-নভেম্বর মাসে। গাছের মুকুল আসার কমপক্ষে তিন মাস আগ থেকে নাইট্রোজেন জাতীয় সার ব্যবহার করা যাবে না।
টবের আমগাছে রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে জৈব সার ব্যবহার করাই শ্রেয়। এতে মাটির গুণাগুণ বজায় থাকবে। কেননা একবার যদি আপনি আম গাছ লাগিয়ে ফেলেন, এরপরে আর মাটি পরিবর্তন করা যায় না। জৈব সার হিসেবে পচা গোবর এবং সরিষার খৈল ব্যবহার করতে হবে। এই সার ব্যবহারের জন্য ২৪ ঘন্টা বা সম্পূর্ণ দিন ভিজিয়ে রেখে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
টবে আম চাষে পানি সেচ
টবে আম চাষের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকের চেয়ে পানির চাহিদা বেশি থাকে। এজন্য প্রায় প্রতিদিনই টবে আম গাছকে পানি সরবরাহ করতে হবে। এছাড়া ফুল আসার পর পানির অভাব যাতে না হয় সেই ব্যবস্থা করতে টবের নিচে জলকান্দা রাখতে হবে। সিমেন্ট বা ইটের টবে যেহেতু নাড়াচাড়া করার ব্যবস্থা নেই, সেহেতু সকাল-বিকাল দুইবার পানি দিতে হবে। সঠিকভাবে পানির অভাব পূরণ হলে গাছে ফল ঝরা বন্ধ হয় এবং ফলন বৃদ্ধি পায়।
আম গাছে কীটনাশক প্রয়োগ
আম গাছে পোকার আক্রমণ দেখা দিলে Ripcord অথবা desis প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম করে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে গাছের বর্তমানে এক ধরনের সাদা তুলোর মতো পোকা দেখা যায় যা অনেকে ফাঙ্গাস বলে কিন্তু তা আসলে ফাঙ্গাস মানে আসলে এটা এক ধরনের পোকা যা গাছে লাগলে গাছ মারা যেতে পারে। এই পোকা দমনের একমাত্র এবং সহজ উপায় হলো যত বেশি পারা যায় গাছে পানি ছিটানো এবং গাছের পাতা ও কান্ড আমি যে তুলে দেওয়া প্রয়োজনে প্রতি ১ লিটার পানিতে এক গ্ৰাম পরিমাণে ডেসিস ও এ্যাডসায়ার মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
আরও পড়ুনঃ আমের শত্রু মিলিবাগ দমন
আম গাছে মুকুল আসার আগে করণীয়
নভেম্বর নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে মাঝামাঝি সময়ে প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম দস্তা, ১.৫ গ্রাম বোরন, ২ গ্ৰাম ভেজিম্যাক্স একত্রে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এতে করে ফলের আকার ভালো থাকবে এবং ফল ফাটবে না।
আমের মুকুল যখন গুটি বের করা শুরু করবে তখন প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম ডেসিস, দুই গ্ৰাম ডায়োথেন ৪৫ এমজি ও ২ গ্ৰাম ভেজিম্যাক্স মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এই ওষুধ গুলো পোকা দমন ও আমের সঠিক বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
আরও পড়ুনঃ আমের বোঁটা পচা রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার
ফলের বিশেষ যত্ন
ছাদবাগানে চাষ করা আম বড় হওয়া শুরু করলে গাছ নুইয়ে যেতে পারেম এছাড়া প্রমাণ সাইজ আম হওয়ার পূর্বেই আমের বোঁটা দূর্বল হয়ে ঝড়ে যেতে পারে। এতে করে আমের ফলন কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেজন্যে আম ধরার সাথে সাথে গাছে অতিরিক্ত অবলম্বন দিয়ে কান্ড শক্ত করে বেধে দিতে হবে। আমের সাইজ একটু বাড়ন্ত হলেই বায়োডিগ্রেডেবল পলিথিন দিয়ে ফলগুলোকে মুড়িয়ে রশি দিয়ে অন্য কোনো অবলম্বনের সাথে জুড়ে দিতে হবে। এতে আম বৃদ্ধি পাওয়ার সুযোগ পাবে।
ফল সংগ্রহ
সাধারণত ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে আম গাছে মুকুল দেখা যায়। এর দুই তিনমাস পরে ফল পাকে। ছাদে চাষ করা আম ১-২ বছরের মধ্যেই ফল দেওয়া শুরু করে। বাগানে লাগানো কলমের আম ৩-৪ বছর বয়সে ফল দেওয়া শুরু করলেও দশ বছরের পূর্বে উপযুক্ত পরিমাণে ফল দেয় না এরা। ছাদবাগানে লাগানো ছোট জাতের আম গাছে সর্বোচ্চ ৫০-৬০ টি উপযুক্ত আকৃতির ফল পাওয়া সম্ভব। পড়শীদের আপনার ছাদবাগানে জন্মানো আম খাওয়াতে চাইলে রঙ ধরেছে এমন বাত্তি আম পাড়াই শ্রেয়।
আরও পড়ুনঃ আমের মুকুল ঝরা প্রতিরোধের উপায়
- বাংলাদেশে পঙ্গপাল আক্রমণের সম্ভাবনা - July 10, 2020
- রকমেলন চাষ ও এর পরিচর্যা - July 6, 2020
- ঘরোয়া উদ্ভিদের রোগ-বালাই নিয়ন্ত্রণ – দ্বিতীয় পর্ব - July 3, 2020