পেঁয়াজের চড়া মূল্যে অন্যান্য সময়ের চেয়ে গুণতে হচ্ছে কয়েকগুণ বেশি দাম। রান্নার এই নিত্য প্রয়োজনীয় আনুসাঙ্গিক ছাড়া বাঙালী ভোজে পরিপূর্ণ রসনা তৃপ্তি পাওয়া একটু দুষ্কর। পেঁয়াজের এই উর্ধ্বগতি মূল্যে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকগুণ কম পেঁয়াজ কিনে দৈনন্দিন রান্নার কাজ চালাতে হচ্ছে। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার ছেড়ে দিয়েছে পেঁয়াজ খাওয়াই। এই মুহূর্তে আপনার বাড়ির ছাদ কিংবা বারান্দা ব্যবহার করে পেঁয়াজ চাষ করা গেলে কেমন হয়? বারান্দায় চাষ করে আপনার পারিবারিক পেঁয়াজের চাহিদা নাও মিটতে পারে, তবে দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতিকালীন সময়ে সামান্য হলেও বাজারের পেঁয়াজ না কিনেই দিব্যি নীরব প্রতিবাদে সামিল হতে পারেন।
পেঁয়াজ বাড়ির ছাদবাগানে কিংবা বেলকুনিতে জন্মানোর জন্য অন্যতম জনপ্রিয় সবজি এবং বসন্তের প্রথম ফসলের মধ্যে একটি। শীতকালে পেঁয়াজকে বহুমুখী ফসল হিসেবে চাষ করে সংরক্ষণ করা যায়।
পেঁয়াজ কাঁচা এবং রান্না উভয় অবস্থায় ব্যবহৃত হওয়া অত্যন্ত জনপ্রিয় সবজি। পেঁয়াজ বা এলিয়াম পরিবারভুক্ত সবজি চাষের জন্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনাঃ
ক) অ্যালিয়াম পরিবারের সকল সবজির জন্যে পূর্ণ রোদ প্রয়োজন।
খ) Allium জাতীয় সবজি চাষে ভাল নিষ্কাশনক্ষমতা সম্পন্ন মাটি প্রয়োজন। পেঁয়াজ বেলে মাটিতে সবচেয়ে ভাল জন্মায়। তাই ভাল ফলনের জন্যে, রোপণের আগে মাটিতে জৈব ফেলনা সামগ্রী এবং কম্পোস্ট যুক্ত করুন।
গ) পানি এবং বায়ু প্রবাহের জন্য প্রচুর জায়গা তৈরি করে দিতে এবং শিকড়গুলি মাটি দিয়ে তাদের পথ তৈরি করতে সহায়তা করতে ১৮ ইঞ্চি পর্যন্ত মাটি আলগা করে দিন।
ঘ) অ্যালিয়ামজাতীয় সবজি নাইট্রোজেন এবং ফসফরাস এর অধিক প্রয়োজন। তাই নাইট্রোজেনের জন্য ব্লাড মিল বা কটন মিল এবং ফসফোরাস হাড়ের গুড়া যোগ করুন।
ঙ) অ্যালিয়ামগুলি খুব বেশি পানি পেলে ভাল হয় না। ড্রিপ সেচ প্রক্রিয়া দিয়ে পানি সেচ দিলে সর্বোত্তম ফলাফল পাওয়া সম্ভব।
চ) প্রতি বছর একই জায়গায় অ্যালিয়ামজাতীয় সবজি লাগানো এড়ানো উচিত। অ্যালিয়ামগুলি মাটিবাহিত রোগের ঝুঁকিতে থাকে তাই কমপক্ষে দুই মওসুম পর পর এদের চাষ করা উচিত। এটি একটি ছোট বাগানে করা কঠিন নয়, কারণ এলিয়ামগুলিকে প্রচুর খোলা স্থানের প্রয়োজন হয় না।
আরও পড়ুনঃ স্পিরুলিনার ১১ টি স্বাস্থ্য উপকারিতা
পেঁয়াজ
ক) পেঁয়াজ রোপণের তিনটি উপায় রয়েছে – সরাসরি জমিতে বীজ দ্বারা, সীডবেড দ্বারা এবং চারা দ্বারা। চারা থেকে বেড়ে ওঠার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
খ) বেশিরভাগ চারাই পাত্রে জন্মায়। এগুলিকে পৃথক করে একের পর এক ৮ ইঞ্চি দূরে দূরে রোপণ করতে হবে।
গ) পেঁয়াজ দিনের দৈর্ঘ্যের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন জাতের হয়ে থাকে – দীর্ঘ, অন্তর্বর্তী এবং সংক্ষিপ্ত। দিনের আলোর পরিমানের উপর ভিত্তি করে এই বিভাজন করা হয়।
ঘ) পেঁয়াজ চাষে আরেকটি বিষয় বিবেচনা হয় তা হল পেঁয়াজের শেলফ লাইফ। পেয়াজভালমানের স্টোরেজে রাখা হলে ছয় মাস অবধি টিকতে পারে, অন্যরা অনেক কম।
ঙ) পেঁয়াজের সবুজ পাতাগুলি যখন মারা যেতে শুরু করবে তখন পেঁয়াজ তোলা উচিত, তবে পেঁয়াজ বীজের অঙ্কুর বেরিয়ে আসার আগে আগে। পেঁয়াজ সাধারণত আরও বেশিদিন রেখে দিলেও ভাল থাকে – তবে পেঁয়াজের কে্নদ্রস্থ শক্ত হয়ে আসতে থাকবে। ফলে খাওয়ার উপযোগী পেঁয়াজ কম থাকবে। পেঁয়াজের যে বাল্ব তৈরি হয়, সেটাও ভালমত টিকবে না এবং তাদের অবিলম্বে ব্যবহার করে ফেলতে হবে।
চ) পেঁয়াজ তোলার পরে, পেঁয়াজগুলি ছায়ায় একটি একটি স্তর করে রাখুন, পাতাগুলি যুক্ত রেখেই। পাতাগুলি সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেলে, সাবধানে ছাঁটাই করে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করুন।
প্রস্তুতি
যদি সার বা কম্পোস্টেড জৈব পদার্থ যুক্ত করে মাটি তৈরি করতে চান, তবে বপন/রোপণের কয়েক সপ্তাহ আগে করে রাখুন।
বপন
পেঁয়াজ বীজ বা স্কন্দ (ছোট আংশিকভাবে বেড়ে ওঠা পেঁয়াজ বাল্ব) থেকে রোপণ করা যেতে পারে।সেটগুলি ব্যয়বহুল তবে তারা তাদের ফলনের হার অন্যান্যদের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে এবং কম পরিশ্রমও প্রয়োজন।
আরও পড়ুনঃ ছাদবাগানে কন্টেইনারে বছরব্যাপী চাষযোগ্য ১২ টি সবজি
যদি বীজ থেকে বপন করা হয় তবে বীজগুলির মধ্যে প্রায় ১ ইঞ্চি পার্থক্য রেখে প্রায় ২ সেন্টিমিটার গভীরতায় বপন করুন। যদি সারিগুলিতে বপন করা হয় তবে সারিগুলি প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার দূরে রাখুন।
বীজ বপনের আগে মাটি আর্দ্র হওয়া জরুরি, তাই বপনের আগের দিন মাটি পরীক্ষা করুন এবং মাটি শুকনো থাকলে পানি সেচ দিন।
যদি পেঁয়াজের স্কন্দ রোপণ করা হয় তবে প্রায় ৩০ সেমি দূরে দূরে রোপণ করুন। পেঁয়াজ স্কন্দ ব্যবহার করে চাষ করলে এদের মাটি আলগা করার প্রয়োজন হয় না। প্রতিটি স্কন্দের জন্য একটি ছোট গর্ত খনন করুন এবং স্কন্ধটি ঘাড়ের উপরের দিকে রাখুন। মাটি দিয়ে ঢেকে দিয়ে স্কন্ধের ডগাটি কেবল মাটির উপরে দেখা যাবে।
ভাল বীজের বৈশিষ্ট্য
১) ভাল বীজ হাত নিয়ে চাপ দিলে চাপ বসে যাবে না।
২) মুখে ঢুকিয়ে দাঁত দিয়ে চাপ দিলে ভেঙ্গে গেলে ভাল বীজ বলা যায়। খারাপ বীজ হলে চ্যাপ্টা হয়ে যাবে।
৩) পানিতে দিলে ভাল বীজ ডুবে যায়। খারাপ বীজ ভেসে উঠবে।
জাত পরিচিতি
বারি পেঁয়াজ-১: জাতটির কন্দ অধিক ঝাঁঝযুক্ত। প্রতিটি গাছে ১০-১২টি পাতা হয়। হেক্টর প্রতি ফলন ১২-১৬ টন। হেক্টর প্রতি বীজের ফলন ৬০০-৬৫০ কেজি। বারি পেঁয়াজ-১ পার্পল ব্লচ ও স্টেমফাইলাম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন। জাতটি রবি মৌসুমে চাষ উপযোগী।
বারি পেঁয়াজ-২: জাতটি বিশেষভাবে খরিফ মৌসুমে অর্থাৎ গ্রীষ্মকালে স্বল্প সময়ের ফসল। এটি দেখতে গোলাকার ও লাল রঙের। আগাম চাষের জন্য মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বীজ তলায় বীজ বোনা যায় এবং এপ্রিল মাসে ৪০-৪৫ দিনের চারা মাঠে রোপণ করা যায়। নাবী চাষের জন্য জুন-জুলাই মাসে বীজতলায় বীজ বুনতে হয়। প্রতি হেক্টরে (২৪৭ শতকে) ফলন ২২ টন।
বারি পেঁয়াজ-৩: জাতটি বিশেষভাবে খরিফ মৌসুমে অর্থাৎ গ্রীষ্মকালে স্বল্প সময়ের ফসল। এটি দেখতে গোলাকার ও লাল রঙের। বীজ বোনার জন্য মধ্য জুন থেকে মধ্য জুলাই মাস উপযুক্ত সময়। আগাম চাষে বীজ বোনার উপযুক্ত সময় হচ্ছে মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহ এবং এপ্রিল মাস চারা রোপণের উপযুক্ত সময়।
বারি পেঁয়াজ-৪: এটি উচ্চ ফলনশীল শীতকালীন পেঁয়াজ। আকৃতি গোলাকার, রং ধুসর লালচে বর্ণের ও ঝাঁঝযুক্ত। হেক্টর প্রতি ফলন ১৭-২২ টন।
বারি পেঁয়াজ-৫: এ জাতটি গ্রীষ্মকালে চাষের উপযোগী স্বল্প সময়ের ফসল। এটি সারা বছরব্যাপী চাষ করা যেতে পারে। বীজ থেকে ফসল উত্তোলন পর্যন্ত ৯৫-১১০ দিন সময় লাগে। হেক্টর প্রতি গড় ফলন ১৮-২০ টন।
আরও পড়ুনঃ ছাদবাগানে শসা চাষ
চাষের সময়
আমাদের দেশে মূলত পেঁয়াজ রবি ও খরিপ মৌসুমে চাষ করা হয়। খরিপ মৌসুমে চাষের জন্য জুলাই-আগষ্ট (শ্রাবণ-ভাদ্র) ও রবি মৌসুমে চাষের জন্য ফেব্রুয়ারী-মার্চ (মাঘ-ফাল্গুন) মাসে বীজ তলায় বীজ বপন করতে হয়।
মাটির ধরণ
উর্বর মাটি এবং পানি নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত টবে পেঁয়াজ চাষ করতে হবে। দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি পেঁয়াজ চাষের জন্য উত্তম। মাটি ল্যুজ হওয়া উচিত। যদি আপনার মাটি ভারী হয় তবে আপনি মাটির মধ্যে কিছু জৈব কম্পোস্ট বা সার ব্যবহার করতে পারেন যাতে এটি আর্দ্রতা ধরে রাখতে পারে। পেঁয়াজ সাধারণত ঠাণ্ডা জলবায়ুর উপযোগী ফসল। যদি পেঁয়াজ চাষ করার সময় তাপমাত্রা বেশি হয় তাহলে উক্ত পেঁয়াজ ঝাঁঝালো।
পেঁয়াজ খানিকটা অম্লীয় মাটি পছন্দ করে – পিঁয়াজ বাড়ার জন্য পিএইচ 5.5-6.5 উপযোগী।
নিড়ানি দ্বারা পেঁয়াজের বেডে ঘন ঘন আগাছামুক্ত করা উচিত,।
যদি বীজ থেকে চাষ করা হয় তবে পিঁয়াজ প্রায় ৫ সেন্টিমিটার উচ্চতায় পৌঁছলে পাতলা করে দিতে হবে।
সার ব্যবস্থাপনা
পেঁয়াজের বেডে গোবর সার, ইউরিয়া, টিএসপি এবং এমওপি সার প্রয়োগ করা হয়। ইউরিয়া, টিএসপি এবং এমওপি এর অনুপাত ৩ঃ২ঃ১.৫ হওয়া জরুরি। জমি তৈরির সময় অর্ধেক ইউরিয়া ও বাকী সমুদয় সার মাটিতে মেশাতে হয়। চারা রোপনের ২০ দিন পর বাকী ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করা হয়।
আরও পড়ুনঃ হরেক রকম গুণসমৃদ্ধ ঝিঙ্গা চাষ
সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনা
শীতকালে জমিতে পানির অভাব থাকলে সেচ দিতে হবে। বর্ষা মৌসুমে যাতে বৃষ্টির পানি দাঁড়াতে না পারে সেজন্য টবে বা বেডে ছিদ্র থাকতে হবে। জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে। সেচের পর জমি নিড়ানি দিয়ে আলগা করে দিতে হবে। পেঁয়াজের কন্দ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ফুলের কুঁড়ি দেখামাত্র ভেঙ্গে দিতে হবে।
ফসল তোলা
ক) পেঁয়াজগুলি শীর্ষভাগ পড়া শুরু হয়ে গেলে এবং হলুদ হয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহ পরে তুলে ফেলার জন্য উপযোগী হয়।
খ) মাটি থেকে পেঁয়াজ তুলতে কাঁটাচামচ ব্যবহার করতে পারেন। স্কিনগুলি ক্ষতিগ্রস্থ না হওয়ার বিষয়ে খেয়াল রাখুন কারণ এটি বিভিন্ন পোকাকে পেঁয়াজ আক্রমণ করতে সাহায্য করে।
গ) রৌদ্রময় দিনে পেঁয়াজ সংগ্রহ করা উচিত, মাটি লেগে থাকলে পরিষ্কার করা উচিত এবং তারপরে কোনো মাটির সার্ফেসে রেখে দিতে হবে যেখানে তারা সূর্য এবং বায়ুর সংস্পর্শে শুকাতে থাকবে। কয়েক দিনের জন্য পেঁয়াজ রেখে দিন সেখানে।
ঘ) পেঁয়াজ শীর্ষ থেকে ২ সেন্টিমিটার উপর থেকে একটি ধারালো ছুরিঢ় সাহায্যে শীর্ষভাগ কেটে দিতে হবে। যাতে পেঁয়াজের বাল্বে কোনো রোগবালাইয়ের সরাসরি আক্রমণ না ঘটে।
ঙ) কোনও ক্ষতিগ্রস্থ পেঁয়াজকে একত্রে রাখবেন না। কারণ এগুলি যদি সংরক্ষণ করা হয় তবে এটি অন্যান্য স্বাস্থ্যকর পেঁয়াজকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে।
চ) যদি আপনি শীতকাল ধরে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতে চান তবে আপনি বায়ু চলাচল পূর্ণ স্থানে ঝুলিয়ে রেখে দিতে পারেন।
- বাংলাদেশে পঙ্গপাল আক্রমণের সম্ভাবনা - July 10, 2020
- রকমেলন চাষ ও এর পরিচর্যা - July 6, 2020
- ঘরোয়া উদ্ভিদের রোগ-বালাই নিয়ন্ত্রণ – দ্বিতীয় পর্ব - July 3, 2020