ঢেঁড়স একটি মালভেসী পরিবারের অন্তর্গত বর্ষজীবি উদ্ভিদ। এর উৎপত্তিস্থল ইথিওপিয়া, এটি মূলত ক্রান্তীয় এবং উপ-ক্রান্তীয় অঞ্চলে জন্মে। বাংলাদেশে প্রধানত বর্ধমান সর্বত্রই এর চাষ করা হয়। শীতকালীন সবজি হলেও বর্তমানে গ্রীষ্মকালেও এটি চাষ করা হয়। ঢেঁড়স প্রধানত সবুজ লম্বাকৃতির পুষ্টিকর ফল। শুকনো ফল এবং বহিরাংশ কাগজ শিল্প এবং ফাইবার শিল্পে ব্যবহৃত ঝয়। ঢেঁড়স ভিটামিন, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম এবং অন্যান্য খনিজ সমৃদ্ধ।
মাটি
ঢেঁড়স বিভিন্ন রকমের মাটিতে চাষ করা যায়। ঢেঁড়স চাষের জন্য জৈব সমৃদ্ধ এবং সুনিষ্কাশনক্ষমতা সম্পন্ন বেলে দোআঁশ থেকে দোআঁশ মাটি আদর্শ। সঠিক নিকাশী সুবিধা পাওয়া গেলে এটি ভারী জমিগুলিতে ভাল জন্মাতে পারে। মাটির পিএইচ ৬ থেকে ৬.৫ হওয়া উচিত। ক্ষার সমৃদ্ধ লনণাক্ত জমিতে ক্ষুদ্র জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলেও ঢেঁড়স চাষ অনুপযোগী।
ঢেঁড়সের জাত
বাগ্লাদেশে ঢেঁড়সের চাষোপযোগী জাত হল শাউনি, পারবনি কানি, বারি ঢেঁড়শ, পুশা সাওয়ানী, পেন্টা গ্রীন, কাবুলী ডোয়ার্ফ, জাপানী প্যাসিফিক গ্রীন ইত্যাদি। শেষের দুটো জাত বছর ব্যাপী চাষ করা হয়।
জমি প্রস্তুতি
জমিটি 5-6 গভীর চাষ দিয়ে প্রস্তুত করা হয়। মাটি ঝুরঝুরে করে লেভেলিং করতে হবে। শেষবার চাষের সময় মাটিতে ১০০ কেজি / একর জমিতে পচে যাওয়া গোবর প্রয়োগ করুন। মাঝে মাঝে প্রধান ফসলের সীমানায়ও ঢেঁড়স বপন করা হয় এবং প্রধান ফসলের মতো বিন্যাসও একই রকম করে করা হয়। বীজ ড্রিল মেশিন, বা হাত দিয়ে ১.৫ থেকে ২ সেমি গভীর মাটিতে বীজ বপন করা উচিত।
আরও পড়ুনঃ ঢেঁড়সের পরিচিতি ও তার অনন্য স্বাস্থ্য গুণাগুণ
বপন
বপনের সময়
এটি বর্ষাকাল এবং শীতে শেষে চাষ করা হয়। বর্ষাকালে এটি জুন-জুলাইয়ের মধ্যে বপন করা হয় এবং বসন্তের মরসুমে ফেব্রুয়ারি – মার্চ মাসে চাষ করা হয়।
ব্যবধান
সারি থেকে সারি ব্যবধান ৪৫ সেমি হওয়া বাঞ্ছনীয় এবং উদ্ভিদ থেকে উদ্ভিদ ১৫-২০ সেমি।
বীজ বপন গভীরতা
১-২ সেমি গভীরে বীজ বপন করতে হবে।
বপন পদ্ধতি
বপনের জন্য ডিবলিং পদ্ধতি ব্যবহার করা উচিত।
বীজের হার
বর্ষাকালীন ফসলের জন্য (জুন – জুলাই) ৪-৬ কেজি/একর বীজ প্রয়োজন। বপন দূরত্ব হওয়া উচিত ৬০*৩০ সেমি। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত একর প্রতি ১৫-৮ কেজি বীজ প্রয়োজন এবং মার্চে বীজ বপনের ৪-৬ কেজি /একর বীজ প্রয়োজন।
বীজ শোধন
বীজ অঙ্কুরণের পুর্বে বীজকে ২৪ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রেখে ট্রিটমেন্ট করতে হবে। কার্বেনডাজিম দিয়ে বীজ ট্রিটমেন্ট করলে মাটিতে জন্মানো ছত্রাকের আক্রমণ থেকে বীজকে রক্ষা করবে। এর জন্য কার্বেনডাজিম দ্রবণে ২ লিটার পানিতে ২ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে ছায়ায় শুকিয়ে নিন। শুকানো শেষে তত্ক্ষণাত বপন শেষ করুন। ভাল অঙ্কুরোদগম এবং মাটিবাহী রোগ থেকে ঢেঁড়সের সুরক্ষার জন্য Imidaclopri (ইমিডাক্লোপ্রি)@ ৫ মিলিগ্রাম ১ কেজি বীজের জন্য এবং তারপরে ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি @ ৪ গ্রাম /কেজি বীজের সাথে শোধন করে নিন।
ফাঞ্জিসাইডের নাম | পরিমাণ (প্রতি কেজি বীজে ডোজের মাত্রা) |
Carbendazim (কার্বেন্ডাজিম) | ২ গ্রাম |
Imidacloprid (ইমিডাক্লোপ্রি) | ৫ গ্রাম |
সার
সারের প্রয়োজনীয়তা (কেজি/একর)
ইউরিয়া | সিঙ্গেল সুপার ফসফেট( | মিউরেট অব পটাশ |
৮০ | মাটি পরীক্ষার উপর নির্ভরশীল | মাটি পরীক্ষার উপর নির্ভরশীল |
পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা (কেজি/একর)
নাইট্রোজেন | ফসফরাস | পটাশিয়াম |
৩৬ | মাটি পরীক্ষার উপর নির্ভরশীল |
মাটি পরীক্ষার উপর নির্ভরশীল |
বেসাল ডোজ হিসাবে ভাল পচা গোবর @ ১২০-১৫০ কুইন্টাল প্রয়োগ করুন। সামগ্রিকভাবে ঢেঁড়সের জন্য ইউরিয়া @ ৮০ কেজি প্রতি একর জমিতে ৩৬ কেজি নাইট্রোজেন আকারে প্রয়োগ করা প্রয়োজন। বীজ বপনের সময় অর্ধেক ডোজ ইউরিয়া প্রয়োগ করুন এবং প্রথমবার ঢেঁড়স তোলার পরে বাকীটা।
ভাল ফলন পাওয়ার জন্য, বপনের ১০-১৫ দিন পরে ১৯ঃ১৯ঃ১৯ অনুপাতে মাইক্রো-নিউট্রিয়েন্টসের সাথে ২.৫ থেকে ৩ গ্রাম / লিটার পানির সাথে স্প্রে করুন। প্রথম স্প্রে করার পরে ১০-১৫ দিন পর পরে ১৯ঃ১৯ঃ১৯ অনুপাতে @ ৪-৫ গ্রাম /লিটার পানির সাথে আবার স্প্রে করুন। ভাল ফুল ও ঢেঁড়স পেতে, ০০ঃ৫২ঃ৩৪ আকারে @ ৫০ গ্রাম / ১০ লিটার পানি দিয়ে ফুল ফোটার পর্যায়ে একবার পরেরবার ফল ধরার পর্যায়ে স্প্রে করুন। উন্নত ঢেঁড়স পেতে ফল বিকাশের পর্যায়ে ১৩ঃ০০ঃ৪৫ (পটাসিয়াম নাইট্রেট) @ ১০০ গ্রাম / ১০ লিটার পানি দিয়ে স্প্রে করুন।
আগাছা নিয়ন্ত্রণ
ঢেঁড়সে আগাছা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ রাখা জরুরি। বর্ষাকালে মাটি কুপিয়ে রাখা উচিত। প্রথমবার আগাছা তোলা হয় বপনের ২০-২৫ দিন পরে এবং দ্বিতীয়বার বপনের ৪০-৪৫ দিন পরে করা হয়। প্রতি একর Fluchoralin ৪৮% @ ১ লিটার প্রতি একরে বা Pendimethalin @ ১ লিটার / একর অথবা Alachlor @ ১.৬ লিটার / একর আগাছা নিয়ন্ত্রণের জন্য উত্থানপূর্ব ভেষজনাশক হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
সেচ
জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে আর্দ্রতা না থাকলে ভাল অঙ্কুরোদগম নিশ্চিত করতে গ্রীষ্ম মৌসুমের ফসল বপনের আগে সেচ দিতে হবে। পরবর্তী সেচ বীজ অঙ্কুরোদগম পরে দেওয়া হয়। তারপরে জমিতে গ্রীষ্মে ৪ থেকে ৫ দিন এবং বর্ষাকালে ১০ থেকে ১২ দিনের পরে সেচ দেওয়া হয়।
ঢেঁড়সের রোগ-বালাই ও পোকা-মাকড়
কীটপতঙ্গ এবং এদের নিয়ন্ত্রণ
অঙ্কুর ও ফল ছিদ্রকারী পোকা(Shoot and Fruit borer)
উদ্ভিদ বৃদ্ধির সময় এই পোকার লার্ভাগুলি অঙ্কুরকে আক্রমণ করে ফলে অঙ্কুরগুলি ঝরে যায়। পরবর্তী পর্যায়ে ফলের ভিতরে লার্ভা অনুপ্রবেশ করে থাকে এবং বিষ্ঠা দ্বারা পরিপূর্ণ করে ফেলে।
দমন
আক্রান্ত অংশগুলি ধ্বংস করে ফেলুন। পোকার সংখ্যা বেশি হলে Spinosad @ ১ মিলি /লিটার পানি বা Chlorantraniliprole 18.5%SC (কোরেজেন) @ ৭ মিলি / ১৫ লিটার পানি বা Flubendiamide @ ৫০ মিলি / একর ২০০ লিটার পানিতে যুক্ত করে স্প্রে করুন।
বিটল(Blister beetle)
বিটল পরাগ, পাপড়ি এবং ফুলের মুকুল খায়।
দমন
যদি এই পোকা লক্ষ্য করেন তবে প্রাপ্তবয়স্কগুলোকে ধ্বংস করুন এবং Carbaryl (কার্বারিল) @ 800 গ্রাম / 150 লিটার জলের স্প্রে বা Malathion (ম্যালাথিয়ন) @ ৪০০ মিলি /১৫০ লিটার পানি বা Cypermethrin (সাইপারমেথ্রিন) @ ৮০ মিলি প্রতি ১৫০ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করে নেওয়া কার্যকর।
এফিড (Aphid)
কচি পাতা ও ফলের উপরে এফিডের কলোনী দেখা যায়। প্রাপ্তবয়স্ক এবং লার্ভা, উভয়ই রস শোষন করে গাছকে দুর্বল করে দেয়। মারাত্মক আক্রমণে এগুলি কচি পাতাকে কুঁচকে ফেলে। তারা মধুর মত একধরণের রস নিঃসৃত করে যা গাচের পাতায় কালো ছাঁচ তৈরি করে।
দমন
এফিড লক্ষ্য করা মাত্রই প্রভাবিত অংশগুলি ধ্বংস করে ফেলুন। বীজ বপনের ২০ থেকে ৩৫ দিন পরে Dimethoate (ডাইমেথয়েট) ৩০০ মিলি /১৫০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করুন। প্রয়োজনে আবার পুনরাবৃত্তি করুন। ক্ষতিগ্রস্থ অংশ লক্ষ্য করা মাত্রই Thiamethoxam (থিয়ামথক্সাম) ২৫WG @ ৫ গ্রাম / ১৫ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করে নিন।
রোগ এবং এর নিয়ন্ত্রণ
শিরা স্বচ্ছতা বা হলুদ শিরা মোজাইক ভাইরাস (Yellow Vein Mosaic Virus)
এই রোগের বৈশিষ্ট্যযুক্ত লক্ষণ হল হলুদ শিরাগুলির একজাতীয় আন্তনেটওয়ার্ক। গাছের বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং আস্তে আস্তে স্তব্ধ হয়ে যায়। ফলগুলি ছোট হয়ে যায় এবং হলুদ বর্ণ ধারণ করে। এটি ৮০-৯০% পর্যন্ত ফলন ক্ষতিগ্রস্থ করে। সাদা মাছি এবং ফড়িংয়ের কারণে এই রোগটি ছড়িয়ে পড়ে।
দমন
প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করুন। রোগাক্রান্ত গাছপালা ক্ষেত থেকে দূরে সরিয়ে ফেলুন। সাদা মাছি নিয়ন্ত্রণে Dimethoate (ডাইমেথয়েট) @ ৩০০ মিলি / ২০০ লিটার পানিতে যুক্ত করে স্প্রে করুন।
পাউডারি মিলিডিউ (Powdery mildew)
সাদা পাউডারি মিলিডিউ বর্ধমান কচি পাতা এবং ফলে দেখা যায়। গুরুতর অবস্থায় অকালে ফল ঝরে যায়। ফলের গুণমান খারাপ হয় এবং সেগুলি আকারে ছোট থাকে।
দমন
যদি জমিতে আক্রমণ দেখা যায় তবে আর্দ্র সালফার ২৫ গ্রাম / ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করুন বা Dinocap (ডাইনোক্যাপ) @ 5৫ মিলি /১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন বিরতিতে ৪ বার করে বা Tridemorph (ট্রাইডেমর্ফ) @ ৫ মিলি বা Penconazol (পেনকনাজল) @ ১০ মিলি / ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন ব্যবধানে ৪ বার করে স্প্রে করুন।
পাতায় দাগ (Cercospora leaf spot) রোগ
পাতার কেন্দ্রস্থল ধূসর এবং সীমানাগুলিতে লাল দাগ দেখা দেয়। মারাত্মক উপদ্রব ক্ষেত্রে পত্রমোচন ঘটে।
দমন
ভবিষ্যতে সংক্রমণ এড়াতে থিরাম দিয়ে বীজ ট্রিটমেন্ট করুন। যদি জমিতে রোগের উপদ্রব দেখা যায় তবে প্রতি লিটার পানিতে Mancozeb (ম্যানকোজেব) @ ৪ গ্রাম /লিটার বা Captan (কাপ্তান) @ ২ গ্রাম /লিটার বা Carbendazime (কার্বেনডাজিম) @ ২ গ্রাম/ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করে নিন। অথবা Difenoconazole/Hexaconazole (ডিভেনোকোনাজোল / হেক্সাকোনাজোল) @ ০.৫ গ্রাম/ লিটার পানিতে মিশিয়ে পাতায় দুই-তিনবার স্প্রে করে দিন।
শিকড় পচা (Root rot)
আক্রান্ত শিকড়গুলি বাদামী বর্ণের হয়ে যায় এবং গুরুতর ক্ষেত্রে উদ্ভিদ মারাও যেতে পারে।
দমন
জমিতে বারবার একই ফসল চাষ এড়িয়ে চলুন এবং এক বছরে বিভিন্ন রকম ফসল চাষ করুন। বীজ বপনের আগে প্রতি কেজি বীজ কার্বেন্ডাজিম @ ২.৫ গ্রাম প্রতি লিটারে পানিতে মিশিয়ে বীজ ট্রিটমেন্ট করুন।
উইল্ট (Wilt)
উইল্ট রোগে প্রাথমিকভাবে পুরানো পাতা হলুদ হয়ে যায়। এটি যে কোনও পর্যায়ে ঢেঁড়সে আক্রমণ করতে পারে।
দমন
যদি পোকামাকড়ে উপস্থিতি টের পান Carbendazim (কার্বেনডাজিম) @ ১০ গ্রাম /১০ লিটার পানির সাথে মিশিয়ে স্প্রে করে দিন।
ফসল তোলা
বীজ বপনের ৬০ থেকে ৭০ দিনের পরে ঢেঁড়স তোলার জন্য প্রস্তুত হয়। ছোট ও নরম ঢেঁড়সগুলি বাছাই করে তুলতে হবে। সকালে এবং সন্ধ্যায় ঢেঁড়স তোলা উচিত। কচি ঢেঁড়স তুলতে বিলম্ব হলে এরা এদের কোমলতা এবং স্বাদ হারাতে পারে। বর্ষাকাল প্রতি হেক্টরে ১২০ – ১৫০ কুইন্টাল ঢেঁড়স পাওয়া যায়। গ্রীষ্মকালীন ঢেঁড়স ৮০-১০০ কুইন্টাল / হেক্টর উৎপাদিত হয়। সময়কাল যথাক্রমে ১০০ এবং ৯০ দিন।
ঢেঁড়সের শেল্ফ লাইফ খুবই অল্প। এদের বেশি দিন রেখে খাওয়া যায় না। শ্লেফ লাইফ বাড়াতে ঢেঁড়স ৭-১০° সেন্টিগ্রেড এবং ৯০% আপেক্ষিক আর্দ্রতায় সংরক্ষণ করা উচিত। স্থানীয় বাজারের বিক্রির জন্য ঢেঁড়সকে পাটের ব্যাগে ভরা হয়। তবে দূরবর্তী বাজারের জন্য ছিদ্রযুক্ত কাগজের বাক্সে ভরতে হবে।
আরও জানুনঃ ঢেঁড়স
- বাংলাদেশে পঙ্গপাল আক্রমণের সম্ভাবনা - July 10, 2020
- রকমেলন চাষ ও এর পরিচর্যা - July 6, 2020
- ঘরোয়া উদ্ভিদের রোগ-বালাই নিয়ন্ত্রণ – দ্বিতীয় পর্ব - July 3, 2020