আমরা অনেকেই ঘরের ভেতরে গাছ রাখতে ভালোবাসি। এমন কিছু ঘরোয়া উদ্ভিদ রয়েছে যা যেমন আমাদের ঘরকে আরেকটু রঙ্গীন করে, তেমনি এদের বেশ কিছু উপকারি দিকও রয়েছে। বাড়িতে গাছ থাকলে ঘরের অল্পবয়স্ক এমনকি নিজেও ঘরোয়া উদ্ভিদের পরিচর্যা শিখতে পারি। এটি খুবই আনন্দদায়ক কাজ। যার একটি বাগান আছে ও কিছু গাছ আছে, সে সবসময়ই সবার চেয়ে কিছুটা উৎফুল্ল থাকে। ঘরোয়া গাছের সবচেয়ে উপকারি দিক হল এরা ঘরের ভেতরের বাতাসকে পরিশুদ্ধ করে।
ঘরের ভেতরের বাতাসকে পরিশুদ্ধ করার প্রয়োজন আছে কি?
ঘরের অভ্যন্তরের বিষাক্ত পরিবেশ
আপনি কি জানেন আপনার ঘর খুব ধীরে ধীরে আপনাকে মৃত্যুর দিকে ঢেলে দিচ্ছে। গবেষণায় জানা গেছে এজমা, ক্যান্সার, এলার্জি, শ্বাসপ্রদাহ, ক্ষীণ স্বাস্থ্য ইত্যাদির সাথে ঘরের ভিতরের পরিবেশের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আপনার ঘর থেকেই ছড়াচ্ছে এইসব মারাত্মক অসুখ-বিসুখ।
বর্ষা মৌসুমে ঘরের ভিতরের স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশের কারণে মোল্ডের বৃদ্ধি ঘটে। শুধু মোল্ডই নয়, কাঠের বিষক্রিয়া, দেওয়ালের রঙ, ভেন্টিলেটরের ছিদ্র, ফিল্টার ইত্যাদি বাতাসে অবমুক্ত হতে থাকে। এটি সবসময়ই আমাদের বাসা বাড়িতে ঘটতে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে যে ১৫.৩ মিলিয়ন ঘরে মানুষ বাতাসের বিষক্রিয়ার ফলে নানান রোগ বাধিয়ে ফেলছে।
শুধুমাত্র বাড়ি বানানোর বিভিন্ন সামগ্রীই ঘরের বাতাসকে দূষিত করার জন্যে যথেষ্ট নয়, আমরা ঘরে যেসব ক্লিনিং দ্রব্য ব্যবহার করি, যেমন ডিটারজেন্ট, ডিশ ওয়াশিং পাউডার, গ্লাস ক্লিনার, টাইলস ক্লিনার ইত্যাদিও ঘরের ভেতরে বিষাক্ততা বাড়িয়েই চলছে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্বায়ী জৈব রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়। এদের মধ্যে অন্যতম হলঃ
ক) এয়ার ফ্রেশনার
খ) কম্বল আসাবাবপত্র ক্লিনার
গ) আসবাবপত্র পলিশিং
ঘ) ব্লিচিং পাউডার
ঙ) ওভেন ক্লিনার্স
নাসা অনুমোদিত বাতাস পরিশুদ্ধকারী গাছের মধ্যে অন্যতম ড্রাসিনা
নাসা অভ্যন্তরীণ দূষিত বাতাস দূরীকরণে ঘরোয়া ল্যান্ডস্কেপিং গাছ নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করে। তারা বেশ কিছু গাছকে পরীক্ষা করে দেখে তাদের কিছু রাসায়নিক পদার্থ যেমন ট্রাইক্লোরোইথিলিন, ফর্মালডিহাইড, বেনজিন দূর করার সক্ষমতা কতটুকু জানতে। এইসব সাধারণ উদ্বায়ী জৈব রাসায়নিক পদার্থ আমাদের ঘর তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম ও ঘর পরিচ্ছন্নকারী প্রোডাক্টে পাওয়া যায়।
বেশ কিছু ড্রাসিনা উদ্ভিদ পরীক্ষা করা হয় এবং দেখা যায় এরা অন্যান্য সাধারণ ঘরোয়া উদ্ভিদের চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় এসব কেমিক্যাল দূর করতে সক্ষম। “জ্যানেট ক্রেইগ” জাতের ড্রাসিনা অন্যান্য জাতের চেয়ে সর্বোচ্চ উচ্চতায় থাকবে। অনেকগুলো গবেষণা রিপোর্ট থেকেই এই ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
খুব সহজেই যত্ন নেওয়া যায়
ড্রাসিনা খুব সহজ পরিচর্যাযোগ্য উদ্ভিদের মধ্যে অন্যতম। এটি সাকুলেন্ট উদ্ভিদের মতোই সহজে যত্ন নেওয়া সম্ভব। ক্লোরিনমুক্ত পানি ছিটিয়ে দিতে হবে সারা গাছে। সরাসরি ট্যাপের পানি ব্যবহার করা ক্ষতিকর যেহেতু এতে ক্লোরিন মিশ্রিত থাকে। তাই শুধুমাত্র পরিশুদ্ধ করা পানি বা বৃষ্টির পানি ব্যবহার করা যেতে পারে সর্বোচ্চ ফলাফলের জন্যে। বেশিরভাগ গাছই উচ্চমাত্রার ক্লোরিনযুক্ত পানি পছন্দ করে না।
এটি সরাসরি সূর্যালোকের চেয়ে ঘরের ভেতরের উজ্জ্বল স্থানে থাকতেই বেশি পছব্দ করে। ছায়াযুক্ত স্থান হলেও কিছুটা মানিয়ে নেয়। ছায়াময় স্থান শুধু একটু ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। আর কোনো অসুবিধা নেই। ড্রাসিনা ছোট পটেও সহজে বেড়ে ওঠে। সামান্য পরিমাণ জৈব রাসায়নিক সার কিংবা কিচেনের ফেলে দেওয়া জৈব উপাদান দুয়ে বানানো সার বছরে ১ বার ব্যবহার করলেই ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারে। ড্রাসিনার জন্যে প্রচুর সারের প্রয়োজন পড়ে না, যেকোনো জাতের ড্রাসিনাই খুব সহজ পরিচর্যাযোগ্য।
ড্রাসিনা উপাহারসামগ্রী হিসেবে দারুন
আগে উপহার হিসেবে বই ছিল রুচিশীল সামগ্রী। এখন খুব সুন্দর পটে করে কোনো ঘরোয়া গাছ দিলেই অনেকে খুশি হন। বইয়ের মতোই এসব উদ্ভিদ এর ব্যবহারকারীকে শুধু দিতেই জানে। জন্মদিন, পার্টি, মাদার্স ডে তে অনেক অনলাইন প্রতিষ্ঠান থেকে রেডিমেড বা নার্সারি থেকেই এসব গাছ কিনে সুন্দর করে প্যাকিং করে গিফট করতে পারেন। আপনি এই উদ্ভিদ উপহার দেওয়ার সাথে সাথে তার ঘরের বায়ুকে নির্মল রাখতেও সাহায্য করছেন। ড্রাসিনা এক্সোটিক উদ্ভিদসমূহের মধ্যে অন্যতম যা কিনা আমাদের দেশে এখন খুব সহজেই বেড়ে উঠছে।
ড্রাসিনা পরিবারভুক্ত উদ্ভিদের অনেকগুলো প্রজাতি রয়েছে। অধিকাংশ প্রজাতিই আফ্রিকা ও অস্ট্রলিয়ার উষ্ণ অঞ্চলের নিজস্ব উদ্ভিদ। ড্রাসিনা আদর্শ ঘরোয়া উদ্ভিদ হিসেবে উজ্জ্বল থেকে সামান্য আলোকিত অঞ্চলে খুব সহজেই বেড়ে ওঠে এবং এর পর্ণরাজি কিছুটা অদ্ভুতরকম।
এদের স্থানীয় আবাসস্থলে এরা চিরসবুজ গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। এদের নমনীয় কিন্তু শক্ত কান্ড ১০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। নতুন কান্ড তৈরির সময় পুরনো অংশ বর্ণহীন হয়ে পড়ে। এমন হওয়া শুরু হলে এগুলো ছেটে ফেলতে পারেন যা কিনা গাছের মূল স্কন্দে অদ্ভুতরকম রিং সদৃশ আকৃতির উদ্ভব ঘটায়।
যেহেতু এরা গ্রীষ্মপ্রধান উদ্ভিদ, গরমকালে এদের বাইরে রেখে দিলে আরও সুন্দরভাবে বেড়ে উঠবে। কিন্তু শীতকালে এদের অবশ্যই বাড়ির ভিতরে রাখতে হবে। রাতের তাপমাত্রা ৫০ ফারেনহাইটের উপরে থাকলে এদের বাইরে রেখে দিতে পারেন। গাছের পাতা রোদে পোড়া ভাবের কারণে বিবর্ণ হয়ে যেতে পারে। এজন্যে সপ্তাহে এক বা দুইদিন ড্রাসিনাকে ছায়াময় স্থান থেকে রৌদ্রজ্জ্বল অংশে ধীরে ধীরে স্থান। পরিবর্তন করে রাখতে হবে।
জাত
কয়েকটি জাতের মধ্যে সুপরিচিত হল-
ড্রাসিনা মার্গিনাটা (Dracena Marginata)
এদের ততোধিক কান্ড বিশিষ্ট শক্ত বল্লমের মতো পাতা, যার কিনারা সবুজ মার্জিনযুক্ত।
ড্রাসিনা কলোরামা(Dracena Colorama)
এরা মার্গিনাটার মতোই তবে এদের পাতা বিভিন্ন রঙের হয়ে থাকে।
রিফ্লেক্সা(Reflexa)
ক্ষুদ্র, গাড় সবুজ রঙের পাতায় অনেকগুলো কান্ড থাকে।
জ্যানেট ক্রেইগ(Janet Craig)
সবুজ পাতা অনেকগুলো মূল কান্ডবিশিষ্ট।
জ্যানেট ক্রেইগ কম্পেক্টা(Janet Craig Compacta)
জ্যানেট ক্রেইগের মতোই কিন্তু ছোট।
ড্রাসিনা স্যান্ডেরিয়ানা(Dracena Sanderina)
এদের কান্ড সরু, সাদা ফালাবিশিষ্ট পাতা।
সবগুলোই বিদেশী জাতের। আমাদের দেশেও এরা বেশ ভাল জন্মে।
চারা রোপন
ড্রাসিনা বেড়ে ওঠার সর্বোচ্চ ফলাফলের জন্যে আপনাকে সুনিষ্কাশন ক্ষমতা সম্পন্ন পটিং সয়েল ব্যবহার করতে হবে। পাতা কুকড়ে যাওয়া।থেকে গাছকে রক্ষা করতে সামান্য পানি দিলেই চলবে।
সার প্রয়োগ
বেড়ে ওঠার সময় শীতকাল ও গ্রীষ্মকালে ২ থেকে ৪ বার সার প্রয়োগ করতে হবে।
সমস্যা
ড্রাসিনা উদ্ভিদের একমাত্র সমস্যাই লিফ স্পট ফাংগাসের আক্রমণ। এটি মূলত ঘরের বাইরে রাখা ড্রাসিনাকে রাতে পানি দিলে কিংবা পাতায় পানি পড়লে হতে পারে। খুব সহজেই প্রতিরোধ করতে পারেন। পর্ণরাজিকে কখনো সিক্ত থাকতে দেওয়া যাবে না। পাতায় পানি দেওয়া যাবে না। ড্রাসিনা উদ্ভিদে কিছু পোকার আক্রমণও ঘটতে পারে। মিলি বাগ ও মাকড়সা এর মধ্যে প্রধানতম। যেকোনো কীটনাশক ব্যবহার করলেই এসব পোকার আক্রমণ থেকে পরিত্রান পাওয়া সম্ভব।
- বাংলাদেশে পঙ্গপাল আক্রমণের সম্ভাবনা - July 10, 2020
- রকমেলন চাষ ও এর পরিচর্যা - July 6, 2020
- ঘরোয়া উদ্ভিদের রোগ-বালাই নিয়ন্ত্রণ – দ্বিতীয় পর্ব - July 3, 2020