ডালিম – যাকে অনেকে আমরা আনার বা বেদানা ইত্যাদি বিভিন্ন নামে চিনি। এটি অন্যতম পরিচিত সুস্বাদু একটি ফল। ডালিমের খাদ্য উপযোগী অংশ এরিল নামে পরিচিত। এর রয়েছে অনেক আয়ুর্বেদিক গুণাবলী। আমাদের ঘরে কেউ অসুস্থ হলেই সকলেই ডালিম খাওয়া পরামর্শ দিই। অসুস্থ রোগী দেখতে যাওয়া আত্মীয়-স্বজনদের জন্যে হাসপাতালের আশেপাশে ডালিমের বিক্রি অনেক বেড়ে যায়। এছাড়াও সুস্বাদু ফালুদা কিংবা অনেকের প্রিয় ডেজার্ট কাস্টার্ড তৈরিতে ডালিমের ব্যবহার অনস্বীকার্য। ডালিমের বীজ এর ফলের বেশি অংশ জুড়ে থাকলেও বীজসহই একে অনায়াসে খাওয়া যায় বিধায় এর মোটামুটি খোসাছাড়া সবটুকুই গ্রহণযোগ্য।
এত সুস্বাদু একটি ফলের উৎপত্তি কিন্তু ইরানে। মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে জলবায়ুতে সেরা ডালিম বা আনারই চাষ হয়। একসময় বাংলাদেশের প্রত্যেক বসতবাড়িতেই একটি দুইটি ডালিমের গাছ চোখে পড়ত। বর্তমানে সৌখিন বাগানীরা ছাদবাগানে শুরু করেছে ডালিমের চাষ।
ডালিমের পুষ্টিমান
ডালিমের বীজ ও খোসা বাদে যে লাল বা গোলাপি ভক্ষনযোগ্য অংশ থাকে তার ১০০ গ্রামে
প্রতি ১০০ গ্রামে ডালিমের পুষ্টিমান ভ্যালু
জলীয় অংশ ৮০.৯ ভাগ
শর্করা ১৬.৯ গ্রাম
প্রোটিন ১.৬ গ্রাম
ফ্যাট ০.১ গ্রাম
আঁশ ৫.১ গ্রাম
খাদ্যশক্তি ৭৪ কিলোক্যালোরি
থায়ামিন ০.০৬ মিলিগ্রাম
রিবোফ্লাভিন ০.১ মিলিগ্রাম
ভিটামিন সি ২৬ মিলিগ্রাম
ক্যালসিয়াম ২১ মিলিগ্রাম
ফসফরাস ০.৭ মিলিগ্রাম
আয়রন ০.৩ মিলিগ্রাম
ডালিমের ঔষধিগুণ
চিকিৎসাসেবায় ডালিমের ভেষজগুণ কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে। ডালিম ফল কৌষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। ডালিম গাছের শিকড়, ছাল ও ফলের খোসা আমাশয় দূর করতে সাহায্য করে। ডালিম বেশ তৃপ্তিদায়ক ফল, তাই এটি মুখের অরুচি দূর করে। মেধা ও বল বৃদ্ধি করে। ডালিমে কিছু এলকোহলীয় উপাদান যেমন সিডোপেরেটাইরিন, পেরেটাইরিন, আইসোপেরেটাইরিন, মিথাইলপেরেটাইরিন থাকায় এটি বিভিন্ন রোগের উপশমে ব্যবহৃত হয়। ইপসম লবণের সেরা ১০ টি ব্যবহার জানুন এখান থেকে।
জালবায়ু ও মাটি
ডালিম শুকনো গ্রীষ্মকালীন আবহাওয়া এবং নিম্ন তাপমাত্রা বেষ্টিত শীতপ্রধান দেশে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের হয়ে থাকে। যেহেতু আমাদের দেশে নিম্ন তাপমাত্রা উত্তরাঞ্চলে খানিকটা পাওয়া যায়, সেহেতু ওইসব অঞ্চলে মোটামুটি ভালমানের আনার বা বেদানা চাষ করা সম্ভব। ডালিম চাষের জন্যে উষ্ণ ও শুষ্ক আবহাওয়া খুবই প্রয়োজন। ডালিমের জন্যে সবচেয়ে ভাল মাটি হল বেলে দোআঁশ বা পলি মাটি। ডালিম কাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না।
ডালিমের জাত ও বংশবিস্তার
বাংলাদেশে ডালিমের কোনো অনুমোদিত জাত নেই। সবই বীজ থেকে চারা তৈরি করে উৎপাদিত। ভারতের কিছু ভাল জাতের ডালিমের বীজ সংগ্রহ করে বাংলাদেশে চাষ করা হয়। এর মধ্যে দুটি জনপ্রিয় জাত হল বেদানা ও কান্ধারী।
ডালিমের বংশবিস্তার মূলত বীজ, কলম ও শেকড় সাকারের মাধ্যমে হয়ে থাকে। শাখা কলম ও গুটিকলম এই দুটি পদ্ধতি অনেক জনপ্রিয় যেহেতু এতে মাতৃ উদ্ভিদের গুণাগুণ বজায় থাকে। শাখাকলম করার জন্যে ১ বছর বয়সী গাছের ২৫-৩০ সেন্টিমিটার আকৃতির ডাল নেওয়া ভাল।
জমি তৈরি
বর্ষা মৌসুমে উঁচু বা মাঝারী উঁচু জমি নির্বাচন করে চারা রোপণ করতে হয়। ছায়াযুক্ত স্থানে ডালিম গাছ লাগানো উচিত নয়। এতে ফলন কমে যায়। রোপনের পূর্বে জমিতে আড়াআড়িভাবে চাষ দিতে হবে। বর্গাকার বা ষড়ভূজাকার পদ্ধতিতে রোপন করা যেতে পারে। রোপিনের উপযুক্ত সময় জুন-জুলাই মাস। আরও পড়ুন চালতার চাষপদ্ধতি।
মাদা তৈরি
গাছ থেকে গাছের উপযুক্ত দূরত্ব ৪ মিটার x ৪ মিটার। গর্ত তৈরি করতে হবে ৬০ সেন্টিমিটার x ৬০ সেন্টিমিটার x ৬০ সেন্টিমিটার আকৃতির। গর্ত তৈরি করে ৫-১০ গর্তটি রোদে শুকাতে হবে যেন কিছু গ্রোথ ব্যাক্টেরিয়া ও ফাঙ্গাস মরে যায়। এরপর ১৫-২০ কেজি পচা গোবর, ২৫০ গ্রাম টিএসপি এবং ২৫০ গ্রাম এমওপি সার দিয়ে গর্ত ভরাট করে নিতে হবে। গর্ত ভরাটের ১০-১৫ দিন পর চারা রোপন করতে হবে।
গর্তের মাঝে চারা বসিয়ে দিয়ে সোজা রাখতে কোনো খুঁটি ব্যবহার করতে হবে। চারা রোপন করেই পানি দিতে হবে গাছে। নিয়মিত পানি দিতে হবে নিয়ম মাফিক।
ছাদবাগানে ডালিম রোপনপদ্ধতি
একটি বড় ড্রাম বা ব্যারেল বাছাই করতে হবে। এই ব্যারেলের নিচে ৩-৪ টি ছিদ্র করে পাথর বিছিয়ে দিতে হবে। এবার বেলে দোআঁশ মাটি ২ ভাগ, গোবর ১ ভাগ, টিএসপি ৪০-৫০ গ্রাম, পটাশ ৪০-৫০ গ্রাম এবং ২০০ গ্রাম হাড়ের গুড়া একত্রে মিশিয়ে ড্রাম বা ব্যারেলে পানি দিয়ে ১০-১৫ দিন রেখে দিতে হবে। তারপর মাটি কিছুটা খুঁচিয়ে আলগা করে দিয়ে আবার ৪-৫ দিন আগের মতো একইভাবে রেখে দিতে হবে। মাটি যখন ঝুরঝুরে হবে তখন একটি সবল সুস্থ কলমের চারা সেই টবে রোপণ করতে হবে। চারা রোপন শেষে খুঁটি বেধে দিতে হবে।
ডাল ছাঁটাই
গাছের গোড়ার দিকে ১-১.৫ মিটার পর্যন্ত কোনো ডাল রাখা যাবে না। এর উপর থেকে প্রতি পাশে ৪-৫ টি ডাল রেখে দিতে হবে যেন সুন্দর আকৃতি বিশিষ্ট হয়। ফল সংগ্রহের পর দূর্বল, রোগাক্রান্ত, মরা ডাল কেটে ফেলতে হবে। ডালিম গাছে পুরনো ডালের চেয়ে নতুন ডালে মুকুল আসার সম্ভাবনা বেশি, সেহেতু পুরনো ডাল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কেটে ফেলে দিতে হবে।
জমিতে সার প্রয়োগ
অন্যান্য ফল গাছের মতোই গাছ বৃদ্ধির সাথে সাথে সারের পরিমাণ বাড়াতে হবে। বিভিন্ন বয়সী গাছে সারের পরিমাণ নিচে দেওয়া হল।
সারের পরিমাণ ১-৩ বছর ৩-৫ বছর ৫-১০ বছর ১০ এর উর্ধ্বে
গোবর(কেজি) ৫-১০ ১০-১৫ ১৫-২০ ২০-২৫
ইউরিয়া(গ্রাম) ১০০-১৫০ ১৫০-২৫০ ২৫০-৪৫০ ৪৫০-৫০০
টিএসপি(গ্রাম) ১০০-১৫০ ১৫০-২৫০ ২৫০-৩০০ ৩০০-৪০০
এমওপি(গ্রাম) ১০০-১৫০ ১৫০-২৫০ ২৫০-৩০০ ৩০০-৪০০
জিপসাম(গ্রাম) ১০০ ১৫০ ২০০ ২৫০
উল্লিখিত সার তিন কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম কিস্তি বর্ষার শুরুতে, দ্বিতীয় কিস্তি ভাদ্র-আশ্বিন মাসে, শেষ কিস্তু শীতের শেষে প্রয়োগ করতে হবে। সবগুলো সার মিশিয়ে মাটিতে ছিটিয়ে দিতে হবে। এরপর চারিপাশে কুপিয়ে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
ছাদবাগানে সার প্রয়োগ
সারের নাম পরিমাণ
গোবর ১০ কেজি
কম্পোস্ট ৫০০ গ্রাম
ইউরিয়া ১৫০ গ্রাম
এমওপি ১০০ গ্রাম
টিএসপি ১০০ গ্রাম
জিপসাম ৭০ গ্রাম
উপরিলেক্ষিত পরিমাণ ১ বছরের চারাতে দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। প্রথমবার মে-জুন মাসে অর্থাৎ বর্ষার প্রারাম্ভে, দ্বিতীয় কিস্তি সেপ্টেম্বর অক্টোবরে। প্রতিবছর সামান্য রকম বাড়ালেই চলবে যেহেতু ড্রামের ডালিম গাছের শেকড় বেশি বিস্তৃতি লাভ করে না।
আগাছা দমন
ডালিম গাছের আশেপাশে আগাছা জন্মাতে দেওয়া যাবে না। আগাছা দেখা দিলেই তুলে ফেলতে হবে। বর্ষার শুরুতে গাছের আশেপাশে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে দিতে হবে। ড্রানের ক্ষেত্রে শাবল দিয়ে খুঁচিয়ে দিলেই হবে।
সেচ ও নিষ্কাশন
মাটিতে অবশ্যই হালকা সেচ দিতে হবে। ডালিম গাছের গোড়া বেশি শুকনো থাকা বা পানি জমে থাকা দুটোই ক্ষতিকর। পানির অভাবে ডালিম ফল গাছে থাকতেই ফেটে যেতে পারে। এজন্যে বোরনমিশ্রিত পানি দিতে হবে।
ফল সংগ্রহ
পরিপক্ক লাভের পর ফলের খোসার রঙ হলদে বাদামী বর্ণ ধারণ করে। এরপরই ফল পেড়ে ফেলতে হয়। বেশিদিন রাখলে ফলের ত্বক ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।
- বাংলাদেশে পঙ্গপাল আক্রমণের সম্ভাবনা - July 10, 2020
- রকমেলন চাষ ও এর পরিচর্যা - July 6, 2020
- ঘরোয়া উদ্ভিদের রোগ-বালাই নিয়ন্ত্রণ – দ্বিতীয় পর্ব - July 3, 2020