ট্রাইকোডার্মা একটি উপকারী ছত্রাক যা উদ্ভিদকে ব্যাকটেরিয়া থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করে। ট্রাইকোডার্মা মাটিতে জন্মানো রোগ থেকে ফসল, শাকসবজিকে রক্ষা করার জন্য খুব কার্যকরী জৈবিক অণুজীব। এটি একটি মুক্ত-জীবিত ছত্রাক যা মাটি এবং মূলের ইকোসিস্টেমগুলিতে জন্মায়। এটি মূল, মাটি এবং পাথরের পরিবেশে অত্যন্ত কার্যকর। এটি অ্যান্টিবায়োসিস, মাইকোপারসিটিজম, হাইফাল ইন্টারঅ্যাকশন এবং এনজাইম নিঃসরণের মতো বিভিন্ন প্রক্রিয়া দ্বারা সৃষ্ট রোগজীবাণু বৃদ্ধি বা সংক্রমণ হ্রাস করে। তারা এমন একটি বাধা তৈরি করে যা ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া এবং প্যাথোজেনগুলির কার্যকরীতা বাধাগ্রস্থ করে।
ট্রাইকোডার্মা প্রকৃতি থেকে আহরিত এমনই একটি অণুজীব যা জৈবিক পদ্ধতিতে উদ্ভিদের রোগ দমনের জন্য ব্যবহার করা যায়। ফলে জমিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমবে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ। এটি ট্রাইকো-সাসপেনশন, পাউডার এবং পেস্ট আকারে উৎপাদন সম্ভব। নিয়মানুযায়ী স্প্রে করলে এর কার্যকারিতা পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক ও মাটিতে বসবাসকারী হওয়ায় একবার ব্যহারের ফলে সেটি মাটিতে ২ থেকে ৩ বছর পর্যন্ত স্থায়ীভাবে থেকে যায়। পঁচা আবর্জনায় ‘ট্রাইকো-সাসপেনশন- এর জলীয় দ্রবণ মিশিয়ে দ্রুত সময়ে ট্রাইকো-কম্পোস্ট উৎপাদন করা সম্ভব।
ট্রাইকোডার্মা ছত্রাকটি চারটি ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি রয়েছে। এগুলো হল ট্রাইকোডার্মা হারজিআম, ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি, ট্রাইকোডার্মা লঙ্গিব্র্যাচিয়াটাম এবং ট্রাইকোডার্মা রিসেই ইত্যাদি। এগুলির প্রত্যেকের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য এবং গুণাবলী রয়েছে।
বিশ্বের প্রায় প্রতিটি মহাদেশের স্থানীয় মাটিতে জৈবিকভাবে ট্রাইকোডার্মা পাওয়া যায়। এগুলি বিভিন্ন তাপমাত্রার মাটিতে পাওয়া যায়। তবে ৭৭ থেকে ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মধ্যে সবচেয়ে ভাল মানের ট্রাইকোডার্মা ছত্রাক পাওয়া সম্ভব। এই তাপমাত্রার বাইরে ছত্রাকটি ততোটা কার্যকরী হয় না।
আরও পড়ুনঃ ঘরেই তৈরি করুন কোকোপিট – ব্যবহার করুন কম্পোস্ট হিসেবে
ট্রাইকোডার্মা অত্যন্ত স্থিতিস্থাপক, এটির অভিযোজন ক্ষমতা অতুলনীয়। যেকোনো ভারী ধাতু এবং ব্যাকটেরিয়ার মুখে এরা দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে।
মাটি খনন, অবকাঠামো নির্মাণ, কীটনাশকের অধিক ব্যবহার, খরা, বন্যা এবং প্রচণ্ড উত্তাপ এর ফলে এই উপকারী ব্যাকটেরিয়া ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। প্রাকৃতিকভাবেই এটি মাটি থেকে সৃষ্ট রোগ থেকে ফসলকে নির্মূল করছে। তাই এটিকে এখন ল্যাবরেটরীতে এনে জার্মিনেশন ঘটিয়ে বায়োকমপোস্ট এবং বায়োফার্টিলাইজার তৈরি করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে ট্রাইকোডার্মার প্রেক্ষাপট
ট্রাইকোডার্মা বায়োপেস্টিসাইড বাংলাদেশের উপযোগী করে সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. বাহাদুর মিয়া। বগুড়ার আরডিএ ল্যাবের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রের উপযোগী করে বাজারে নিয়ে আসা হয় ২০১৩ সালের জুন মাসে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ৭টির মতো পূর্ণাঙ্গ ল্যাবে ট্রাইকোডার্মা উৎপাদন করে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাতও করে। ট্রাইকোডার্মা একটি ব্যয়সাশ্রয়ী বায়ো পেস্টিসাইড ও কমপোস্ট। এটি ব্যবহারে ৪০-৬০ ভাগ রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমায়। ট্রাইকোডার্মা সাসপেনশন থেকে তৈরি বায়োপেস্টিসাইড ব্যবহারে কীটনাশকের খরচ কমায় ৩০ ভাগ পর্যন্ত। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আ.ফ.ম. জামাল উদ্দিনের গবেষণায় দেখা গেছে, ট্রাইকোডার্মা ব্যবহারে টমেটোর বৃদ্ধি ১.৫ গুণ বেড়েছে। অর্থাৎ ট্রাইকোডার্মা একইসাথে ফসলের উৎপাদন বাড়িয়ে কৃষকের খরচও কমাচ্ছে। এজন্যে ট্রাইকোডার্মা কমপোস্ট ও বায়োপেস্টিসাইড শহরে ছাদবাগানে টেকসই অর্গানিক ফার্মিং কে আরও বাস্তবায়ন ঘটাতে একটি উপলক্ষ হতে পারে।
ট্রাইকোডার্মার উপকারিতা
১) রোগ নিয়ন্ত্রণঃ ট্রাইকোডার্মা একটি শক্তিশালী বায়োকন্ট্রোল এজেন্ট এবং মাটি জন্মানোর রোগের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এটি বিভিন্ন প্যাথোজেনিক ছত্রাক যেমন ফিউজেরিয়াম, ফাইটোপথেরা, স্ক্লেরোশিয়া বিরুদ্ধে সফলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
২) উদ্ভিদ বৃদ্ধিতে সহায়কঃ ট্রাইকোডার্মা ফসফেট এবং মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টকে পানিতে দ্রবীভূত করতে সহায়তা করে। ট্রাইকোডার্মা উদ্ভিদে প্রয়োগের ফলে এর গভীর শিকড়ের সংখ্যার বৃদ্ধি ঘটায়, ফলে খরা প্রতিরোধ করতে উদ্ভিদের ক্ষমতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
৩) রোগের জৈব রাসায়নিক এজেন্টঃ ট্রাইকোডার্মা ফসলের প্রতিরোধক্ষমতা প্রভাবিত করতে সহায়তা করে। ট্রাইকোডার্মা দ্বারা উত্পাদিত তিনটি শ্রেণি এবং উদ্ভিদের প্রতিরোধক্ষমতা প্ররোচিত করা সক্ষমতা এখন আবিষ্কৃত। এই যৌগগুলি প্রয়োগকৃত গাছে ইথিলিন উৎপাদন, উচ্চ সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়ায় সাড়া প্রদান এবং অন্যান্য প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত প্রতিক্রিয়া প্ররোচিত করে।
আরও পড়ুনঃ পটিং মিক্স
৪) ট্রান্সজেনিক গাছপালাঃ ট্রাইকোডার্মার এন্ডোকাইটিনেজ জিন তামাক এবং আলু গাছের ছত্রাকের বৃদ্ধির প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তুলেছে। অলটারনারিয়া অল্টানাটা সোলানি এবং বোট্রিটিস সিরেরিয়া এবং বিভিন্ন মাটিবাহিত রোগজীবাণু, রিজেক্টোনিয়া এসপিপি- তে যেমন পাতাগুলি প্যাথোজেনগুলির পক্ষে অত্যন্ত সহনশীল।
৫) জৈব প্রতিষধকঃ কীটনাশক এবং ভেষজনাশক দ্বারা দূষিত মাটির জৈব শোধনে ট্রাইকোডার্মা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরা অপ্রয়োজনীয় কীটনাশকের ব্যবহার হ্রাস করে।
৬) মাটির বিষক্রিয়া হ্রাসঃ ট্রাইকোডার্মা মাটিতে কেমিক্যাল ও কীটনাশকের আধিক্যজনিত বিষক্রিয়া সৃষ্টি হলে তা কমাতে সাহায্য করে এবং একইসাথে অম্লতা ও পিএইচ এর মাত্রা সঠিক রাখতে সহায়তা করে।
৭) মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষাঃ মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষায় সহায়তা করে এবং উর্বরা শক্তিকে দীর্ঘস্থায়ী করে। ফলে মাটি পুষ্টিসমৃদ্ধ হয় এবং উর্বরাক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
ট্রাইকোডার্মার ব্যবহার
ট্রাইকোডার্মা সব ধরণের গাছপালা এবং শাকসবজি যেমন ফুলকপি, তুলা, তামাক, সয়াবিন, আখ, চিনি, বেগুন, লাল ছোলা, কলা, টমেটো, মরিচ, আলু, লেবুজাতীয় ফল, পেঁয়াজ, চিনাবাদাম, মটর, সূর্যমুখী, বেগুন, চা, আদা, হলুদ, গোলমরিচ, পান, এলাচ ইত্যাদিতে সফলভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব।
বাজারে ট্রাইকোডার্মা
মূলত বাজারে ট্রাইকোডার্মা পাউডার হিসেবে পাওয়া যায়। এছাড়া অনেক কোম্পানী ট্রাইকোডার্মা হতে রেডিমেইড কম্পোস্ট ও পেস্টিসাইড তৈরি করে বাজারজাত করে। ট্রাইকোডার্মা পাউডার কিনে জৈব বর্জ্যে ছিটিয়ে দিতে হয়। এভাবে ৩৫-৫০ দিন রেখে দিলে ছত্রাকগুলো বর্জ্যকে পচিয়ে খুবই ভাল মানের কম্পোস্টে পরিণত হয়। এটি ভার্মিকম্পোস্টের বিকল্প হিসেবেও ব্যবহার করতে পারেন।
ট্রাইকোডার্মা পাউডারকে ১৬ লিটার পানিতে ৮০ গ্রাম মিশিয়ে তৈরি সাসপেনশনটি দিয়ে বায়োপেস্টিসাইড তৈরি করা হয়। এই বায়োপেস্টিসাইড মাটি-জনিত রোগজীবানুর ক্ষেত্রে খুবই কার্যকরী পেস্টিসাইড।
বগুড়ার আরডিএ ল্যাব ট্রাইকোডার্মা প্রস্তুত করে কৃষকদের বাজারজাত করে। এছাড়াও ইকোপ্লাস দিনাজপুরে নিজস্ব ল্যাবে ট্রাইকোডার্মা উৎপন্ন করে বাজারজাত করে। তারা জমি ও ছাদবাগানের জন্যে ট্রাইকোডার্মা কম্পোস্টও দিয়ে থাকে। ইকোপ্লাস ট্রাইকোডার্মা পেতে যোগাযোগ করুন ০১৫২১৪৩৭১২৯ -এ।
ট্রাইকোডার্মা কম্পোস্ট ও বায়োপেস্টিসাইড ছাদবাগানের জন্যে খুবই কার্যকরী একটি উপাদান। এটি ফলন বৃদ্ধির সাথে সাথে এর খরচও কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া এটি সম্পূর্ণ জৈব উপাদান হওয়ায় আপনার উৎপাদিত ফল ও সবজি একেবারে কেমিক্যালমুক্ত থাকে। তাই ছাদবাগানীদের ট্রাইকোডার্মা সম্বন্ধে আরও বিস্তর গবেষণা করে এর ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ য়য়া উচিত।
- বাংলাদেশে পঙ্গপাল আক্রমণের সম্ভাবনা - July 10, 2020
- রকমেলন চাষ ও এর পরিচর্যা - July 6, 2020
- ঘরোয়া উদ্ভিদের রোগ-বালাই নিয়ন্ত্রণ – দ্বিতীয় পর্ব - July 3, 2020