রাতের বেলা রজনীগন্ধার আবেদনময়ী সুবাস যেকোনো বাঙ্গালী হৃদয়কেই পাগল করে দেয়। সাদা রঙের হওয়ায় বাগানের শোভা বাড়ানো ছাড়াও বিভিন্ন উৎসব-পার্বণ ও গৃহ সজ্জায় ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। দিনদিন এই ফুলের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে আমাদের দেশে বানিজ্যিকভাবে এর যথেষ্ঠ চাষাবাদ হচ্ছে।
এটি “রজনীগন্ধা”, “নিশিগন্ধা”এবং “তরোয়াল লিলি” নামেও পরিচিত। এটি একটি ভেষজ বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ যার ডাঁটার দৈর্ঘ্য ৭৫-১০০ সেমি হয়ে থাকে। এই ডাঁটার চারিপাশে সাদা রঙের ১০-২০ টি করে ফানেল আকৃতির ফুল বহন করে। এই ফুল দিয়ে নানা ঢঙের ফুলের তোড়া বানানো হয় এর মনোমুগ্ধকর আকৃতি এবং মিষ্টি সুগন্ধের জন্যে। আলগা ফুলগুলো বেণী তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয়। রজনীগন্ধা টব এবং বাগানে বেড়ে ওঠার জন্য উপযুক্ত এবং এর থেকে ভাল সুগন্ধী তেল উত্তোলন করা যায়।
জাত
ফুলের পাঁপড়ি বা স্পাইকের সারি অনুযায়ী রজনীগন্ধা তিন ভাগে বিভক্ত। সিঙ্গেল, সেমি-ডাবল ও ডাবল। যে সব জাতের ফুলের পাঁপড়ি বা স্পাইক একটি সারিতে থাকে সে সব জাতগুলি সিঙ্গেল শ্রেনীভুক্ত, যে সব জাতে ফুলের পাঁপড়ি দুই বা তিন সারিতে থাকে সে জাতগুলিকে সেমি-ডবল এবং তিন-এর অধিক পাঁপড়ির সারি থাকলে সে জাতগুলিকে ডাবল শ্রেনীর আওতাভুক্ত হিসেবে ধরা হয়ে যায়।
মাটি
সুনিষ্কাশন ক্ষমতাসম্পন্ন দোআঁশ ও বেলে মাটি রজনীগন্ধা চাষের জন্যে উপযুক্ত। মাটির পিএইচ 6.5-7.5 থাকা এর বৃদ্ধির জন্য আদর্শ মান।
জমি প্রস্তুতি
রজনোগন্ধা রোপনের জন্য, ভালভাবে জমি চাষ করে নেওয়া প্রয়োজন। মাটি ঝুরঝুরে করে উপযুক্ত বানাতে হবে, এর জন্যে ২-৩ টি চাষ করা প্রয়োজন হয়। রোপণের সময় পচা গোবর সার @১০-১২ টন /একর যোগ করুন এবং জমিতে ভালভাবে মিশ্রিত করুন।
বীজ
বীজের হার
২১০০-২৫০০ বাল্ব / একর জমিতে ব্যবহৃত হয়।
বীজ শোধন
বপনের আগে বাল্বগুলি মাটিজনিত রোগ থেকে রক্ষা পেতে ৩০ মিনিট ধরে Thiram ০.০.১% বা Captan ০.০.২% বা Emisan ০.০.২% বা Benlate @ ০.২১% বা Bavistin @ ০.২৯ কে প্রতি কিলোগ্রামে ২ গ্রাম মিশিয়ে চিকিত্সা করতে হয়।
আরও পড়ুনঃ মন মাতানো জুঁই ফুলের চাষ
বপন
বপনের সময়
মার্চ-এপ্রিল মাস বীজ বপনের জন্য সর্বোত্তম সময়।
ব্যবধান
রোপণ অরতে ৪৫ সেন্টিমিটার ফাঁকা রেখে করা হয়। ৯০ সেমি প্রশস্ত বীজতলা প্রস্তুত করে নিতে হবে।
বপন গভীরতা
মাটিতে বাল্ব ৫-৭ সেমি গভীরে বপন করুন ।
বংশবৃদ্ধি
বংশবিস্তার বাল্বের দ্বারা করা হয়। ১.৫-২.০ সেমি ব্যাস এবং ৩০ গ্রামের বেশি ওজনযুক্ত বাল্বগুলি বংশবিস্তারের জন্য ব্যবহৃত হয়। একক বাল্বের ক্ষেত্রে, ১ বা ২ বা ৩টি করে বাল্ব বপন করা হয়। এক বছর চাষের জন্যে প্রতি হিলে ৩ টি করে বাল্ব রোপণ করা হয় এবং প্রতি হিলে ১ বা ২ বাল্ব রোপন করা হয় এক বছরের অধিক সময় ধরে চাষের জন্য। দুই বা ততোধিক বাল্বের ক্ষেত্রে এক বছরের ফসলের জন্য কেবল দুটি রোপণ করাই যথেষ্ট।
সার
সারের প্রয়োজনীয়তা (কেজি / একর)
ইউরিয়া | সিঙ্গেল সুপার ফসফেট | মিউরেটস অব পটাশ |
৬৪০ | ২৫০ | ৬০ |
পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা (কেজি / একর)
নাইট্রোজেন | ফসফরাস | পটাশিয়াম |
২৯৬ | ৪০ | ৪০ |
জমি প্রস্তুতির সময় ২০-২৫ টন/ একর পচা গোবর যোগ করুন। সিঙ্গলে সুপার ফসফেট@ ২৫০ কেজি / একর ফসফরাস আকারে এবং মিউরেটস অব পটাশ@ ৬০ কেজি / একর পটাশ আকারে জমিতে যোগ করুন।
ফুল বৃদ্ধির সময়, ইউরিয়া @৬৪০ কেজি / একর আকারে নাইট্রোজেন যুক্ত করুন। নাইট্রোজেনের অর্ধেক ডোজ বপনের এক মাস আগে যুক্ত করা হয় এবং তারপরে বাকি ডোজ আগস্ট মাস পর্যন্ত সমান পরিমাণে ১ মাস পর পর দিতে হবে। সার যোগ করার পরে ভাল করে সেচ দিতে হবে।
আগাছা নিয়ন্ত্রণ
ক্ষেত আগাছামুক্ত করতে, ৩-৪ বার আগাছা উত্তোলন প্রয়োজন। চারা রোপনের সাথে সাথেই এবং রোপণের ৪৫ দিন পরে, ২০০ লিটার পানিতে Atrazine@ ০.৬ কেজি / একর বা oxyfluorfen@ ০.২ কেজি/ একর বা pendimethalin@৮০০ মিলি/ একর আগাছা নিরোধক হিসাবে স্প্রে করতে হবে।
সেচ
বাল্ব ফোটা না পর্যন্ত কোনও সেচের প্রয়োজন হয় না। অঙ্কুরোদগম এবং ৪-৬টি পাতা গজালে সেচ দেওয়া প্রয়োজন। এক সপ্তাহে একবারই দিতে হয়। মাটি এবং জলবায়ু অবস্থার উপর নির্ভর করে ৮-১২ বার সেচ প্রয়োজন।
আরও পড়ুনঃ চন্দ্রমল্লিকা ফুলের চাষ পদ্ধতি
ঘাটতি এবং তাদের প্রতিকার
নাইট্রোজেনের ঘাটতি:
নাইট্রোজেন ঘাটতির কারণে স্পাইকের সংখ্যা কমে যায়। পাতা ফ্যাকাশে সবুজ বর্ণের হয়ে যায়।
ফসফরাস ঘাটতি
ফসফরাস ঘাটতির কারণে পাতার উপরের অংশ গাড় সবুজ বর্ণের এবং নীচের পাতা বেগুনি বর্ণের হয়ে যায়। ফলস্বরূপ বৃদ্ধি এবং ফুলের সংখ্যা কমে যায়।
ক্যালসিয়ামের ঘাটতি
এর ঘাটতির ফলে স্পাইক ফেটে যায়।ক্যালসিয়ামের তীব্র ঘাটতির ফলে কুঁড়ি পচে যায়।
ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতি
পুরানো পাতাযর শিরায় ক্লোরোসিস দেখা দেয়।
আয়রনের ঘাটতি
নতুন পাতাযর শিরায় ক্লোরোসিস দেখা দেয়।
বোরনের ঘাটতি
ফলস্বরূপ পাতার ধার ফেটে যায় এবং পাতা বিকৃত হয়ে যায়।
ম্যাঙ্গানিজের ঘাটতি
এর অভাবে পাতার নীচের তলদেশের শিরাগুলি হলুদ হযয়ে যায়।
রজনীগন্ধার রোগ-বালাই ও এর প্রতিকার
রোগ এবং এর নিয়ন্ত্রণ
কাণ্ড পচা
Sclerotium rolfsii দ্বারা সৃষ্ট। লক্ষণগুলি হল পাতার পৃষ্ঠে ছত্রাকের বৃদ্ধি। স্পট অংশটি তার সবুজ রঙ হারিয়ে ফেলে এবং পাতা ঝরে পড়ে।
দমন
কাণ্ড পচা থেকে মুক্তি পেতে মাটিতে ১২.৫ কেজি/ একর ব্রাসিকোল(২০%) প্রয়োগ করুন।
বোট্রিটিস স্পট এবং ব্লাইট
এটি মূলত বর্ষাকালে ছড়ায়। লক্ষণগুলি হল বাদামী রঙের দাগ ফুলগুলিতে দেখা যায়, পরিণামে পুরো ফুল ধ্বসে যায়।
দমন
Carbendazim @ 2 গ্রাম / লিটার পানির 15 দিনের ব্যবধানে স্প্রে করলে দাগ এবং দোষ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে
পাতা মোচড়ানো
লক্ষণগুলি হল পাতা ঢলে পড়ে। পাতা হলুদ হয়ে শেষ পর্যন্ত শুকিয়ে যায়। এটি ধীরে ধীরে পুরো উদ্ভিদকে প্রভাবিত করে। সংক্রামক কাণ্ড এবং বোঁটায় ঘন সুতির মত বৃদ্ধি দেখা যায়।
দমন
Zineb@ ০.০৩%প্রতি একরে ১ লিটার পানিতে ২ গ্রাম মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
কীটপতঙ্গ এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ
এফিডস
এগুলি ক্ষুদ্র পোকামাকড় যা ফুলের কুঁড়ি এবং কচি পাতায় খেয়ে ফেলে।
দমন
১৫ দিনের ব্যবধানে ম্যালাথিয়ন @০.১% প্রতি একরে ৩ মিলি/ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করলে এফিড থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করবে।
থ্রিপস
এরা ফুলের ডাঁটা, পাতা এবং ফুলগুলি খেয়ে ফেলে।
দমন
থ্রিপস থেকে নিরাময়ের জন্য ৩ মিলি লিটার ম্যালাথিয়ন@০.১% প্রতি একর জমির জন্যে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হয়।
গুবড়ে পোকা
এগুলি গাছের অঙ্কুর এবং পাতার ক্ষতি করে। তারা পাতার কিনারায় এবং শিকড়গুলি খেয়ে ফেলে।
দমন
BHC dust@ ১০% গুবড়ে পোকা থেকে রক্ষা করার জন্য মাটিতে ব্যবহার করুন।
ঘাসফড়িং
তারা ছোট পাতা এবং ফুলের মুকুল খায়। এছাড়াও এরা ফল এবং ফুলের ক্ষতি করে।
দমন
ম্যালাথিয়ন ০.০.১% বা Quinalphos @ ০.০৫% বা Carbaryl @০.০.১% ৬ গ্রাম প্রতি লিটারে মিশিয়ে একর প্রতি স্প্রে করতে হবে।
কুঁড়ি ছিদ্রকারী পোকা
এগুলি প্রধানত ডিম পেড়ে দিয়ে কুঁড়িকে ক্ষতিগ্রস্থ করে এবং এরপরে লার্ভা ফুলের মুকুল খেয়ে ফেলে কুঁড়িতে গর্ত তৈরি করে।
দমন
কুঁড়ি ছিদ্রকারী পোকা থেকে রক্ষা পেতে Carbaryl @ ০.২% ৬ গ্রাম প্রতি লিটারে মিশিয়ে প্রতি একর জমিতে স্প্রে করা হয়
ফসল কাটা
রোপণের ৩-৩.৫ মাস পরে ফুল সংগ্রহ করা যেতে পারে। ফুল ফোটার জন্য উপযুক্ত সময় হল আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস। প্রধানত নিচের ২-৩ টি ফুলের কুঁড়ি খোলা থাকলেই ফসল সংগ্রহ করা যায়। স্পাইকগুলি ধারালো ছুরির সাহায্যে কেটে সংগ্রহ করা হয়। প্রথম বছরে এটি গড়ে ১.৪-২ লাখ স্টিক প্রতি একর এবং ২.৫-৬ লাখ আলগা ফুল প্রতি একরে দেয়। দ্বিতীয় এবং পরের বছরগুলিতে, এটি গড়ে ২-২.৫ লাখ স্টিক প্রতি একর এবং ৪-৫ লাখ আলগা ফুল দেয়। ফুল সংগ্রহের পরে স্পাইকগুলি কেটে ফেলা উচিত। পরবর্তীতে ফুলগুলি গানি ব্যাগ বা ভেজা সুতির কাপড়ের উপর বসিয়ে ছায়ায় রেখে দিতে হবে।
- বাংলাদেশে পঙ্গপাল আক্রমণের সম্ভাবনা - July 10, 2020
- রকমেলন চাষ ও এর পরিচর্যা - July 6, 2020
- ঘরোয়া উদ্ভিদের রোগ-বালাই নিয়ন্ত্রণ – দ্বিতীয় পর্ব - July 3, 2020