আম্রপালি আমকে যদি কেউ আপনার কাছে দেশী আম্রপালি বলে বিক্রির চেষ্টা করে, তার থেকে সাবধান। সে আম সম্পর্কে কিছুই জানেনা।
লেখার শুরুতেই ভয়াবহ এক কথা দিয়ে শুরু করলাম, তবে ধীরে ধীরে আপনার দিব্যদৃষ্টি উন্মোচন করবো, প্যারা না খেয়ে আরামসে পড়া শুরু করতে পারেন। পড়া শুরু করার আগে একটা আম খেয়ে নিতে পারেন। অথবা পড়ার ফাঁকেও খেয়ে নিতে পারেন, এই আর্টিকেল পড়তে পড়তে যদি একটা আম খেয়ে নিতে পারেন, তবে বডিতে এন্টি-অক্সিডেন্ট এর সাথে সাথে মিলবে কার্বোহাইড্রেট, বিটা ক্যারোটিন, থায়ামিন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন সি।
তার মানে এই আর্টিকেল পড়তে পড়তে আপনি চাইলেই ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করতে পারেন এবং রুখে দিতে পারেন করোনা ভাইরাসকেও। তো চলুন আম খাওয়া যাক, মানে আম নিয়ে বকবকানি শুরু করা যাক।
আজকে আমি কথা বলবো মূলত বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ৪/৫ টি আমের জাত নিয়ে, সাথে থাকবে Buying Guide, কখন কোন আম বাজারে আসবে, কখন কোন আম কি দেখে কিনবো, মোটামুটি একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করবো। এতোক্ষন ইন্ট্রো দিলাম, এবার যাওয়া যাক মূল ভূমিকায়।
১) আম্রপালি/আম্রপালী/রুপালী
এই নামটি হাইব্রীড জাতের আম। উত্তর ভারতের হার্টথ্রব আম দুশেহেরী হলো এই আম্রপালির মা, আর দক্ষিণ ভারতের সুপার স্টার হিরো নীলম জাতের আম হলো এই আমের পিতা।
১৯৭৮ সালে ভারতীয় বিজ্ঞানীগণ এই জাতকে বৃজি নামক গণরাষ্ট্রের এক মহিয়সী নারীর নামে এই জাতের নামকরণ করেন। আমাদের দেশে এই জাত আসে ৮০/৮৫ সালের দিকে। শুরুতে এই আম শুধু রাজশাহী অঞ্চলে চাষ করা শুরু হলেও বর্তমানে রাঙ্গামাটি,বান্দরবান সহ পাহাড়ি অঞ্চলেও এই আমের চাষ হচ্ছে।
আম্রপালি আম কিছুটা ছোট হয় আকারে, লম্বাটে এবং নিম্নাংশ কার্ভি, পোক্ত অবস্থায় সবুজ, অথবা লালচে হলুদ কালার এর দেহাবরণ,পাকার পরে আকর্ষনীয় রং ধারণ করে। সেই পোশাকের ভেতর লুকিয়ে রাখা কড়া মিষ্টি আঁশবিহীন লোভনীয় এক মাংসল দেহ।
এই আম পাকা শুরু করে জুনের শেষ থেকে জুলাই এর শুরুর দিকে। আমের ওজন বলতে গেলে ৫/৬ টি আম ধরে প্রতি কেজিতে।
একদম শুরুর কথায় আসি, আম্রপালি মূলত ভারতীয় জাত, যা এদেশে ইন্ট্রুডিউসড ভ্যারাইটি, তাই কেউ যদি দেশী আম্রপালি বলে আপনার কাছে ক্রেডিট নিতে আসে, তাকে আমার এই লেখার এর তথ্যটি জানিয়ে দিন, জানার কোনো বয়স তো নাই।
২) হিমসাগর/খিরসাপাত
বাংলাদেশের GI (Geographical Indication) সার্টিফিকেট পাওয়া একমাত্র হিরোইন এই খির্সাপাত বা হিমসাগর আম।
পশ্চিমবঙ্গের জাতের নাম যদিও হিমসাগর যা রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় খির্সাপাত নামে বেশী জনপ্রিয়। যদিও ঢাকায় এই আম হিমসাগর নামেই বাজার দখল করে রাখে।
আমের আকৃতি খুবি আবেদনময়ী, কিছুটা গোলাকার, নাদুসনুদুস এই আমের ওজন ১৭০ থেকে ৩৫০/৪০০ গ্রাম পর্যন্ত হতে পারে। একটু বেশী আবেদনময়ী হওয়ায় এই আমের দেহাবরণ কিছুটা ভারি, পর্দানশীল আম কিনা। দেহাবরণ সবুজ, পাকলে হলুদাভ সবুজ বর্ণ ধারণ করে।
দেহাবরণ উন্মুক্ত করলেই ভেসে উঠবে আঁশবিহীন, রসালো, মিষ্টি এক কড়া হলুদ দেহ, যা একবার খাওয়ার পর আপনি হারিয়ে যেতে পারেন অন্য এক দুনিয়ায়। এই আম সাধারণত জুনের শুরু থেকে পাড়া শুরু হয়, জুন শেষ হওয়ার আগেই বাজার থেকে এই আম হারিয়ে যায় আড়ালে আবডালে।
৩) হাড়িভাঙ্গা
ইতিহাসের পাতা থেকে জানা, রংপুর জেলার বালুয়া মাসিমপুর ইউনিয়নে অবস্থিত জমিদার বাড়ীর বাগানে সৌখিন রাজা তাজ বাহাদুর শিং তার এলাকায় আমদানীকৃত অনেক ফুল ও ফল গাছের বাগান করেছিলেন। কিন্তু ১৯৮৮ সালের বন্যায় সেই সখের বাগান যমুনেশ্বরী নদী বুভুক্ষের মত খেয়ে ফেলে। পরবর্তীতে ১নং খোরাগাছ ইউনিয়নের তেকানী গ্রামের নফল উদ্দিন পাইকার জমিদার বাগানের আমদানীকৃত আমের মধ্যে একটি আম অত্যন্ত সুস্বাদু, সুমিষ্ট ও দর্শনীয় হওয়ায় সেখান থেকে একটি কলম (চারা) নিয়ে এসে নিজ জমিতে রোপন করেন ।
কিন্তু রংপুরের মঙ্গার দরূন শুকনো মৌসুমে গাছের গোড়ায় পানি দেয়ার সুবিধার্থে একটি হাড়ি বসিয়ে ফিল্টার পদ্ধতিতে পানি সেচের ব্যবস্থা করেন কিন্তু অল্পদিনের ব্যবধানে কতিপয় লাচার লোকজন উক্ত হাড়িটি ভেঙ্গে ফেলেন এবং নিজেদের পাশবিকতার পরিচয় দিয়ে এক কালরাত্রির সূচনা করেন। কিন্তু সকল ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে কালের বিবর্তনে আম গাছটি গর্বের সহিত গর্ভবতী হয়, মানে ফলবান বৃক্ষে পরিণত হয় । মৃত নফল উদ্দিন সেই খুশিতে উক্ত গাছের আম পুরো এলাকাবাসীকে বিতরণ করেন। উক্ত গাছের আম খাওয়ার পর এত সুস্বাদু আমের উৎস সম্বন্ধে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি চতুরতার সাথে হাড়ি ভেঙ্গে ফেলা লোকজন কে মৃদু ভর্ৎসনা করার উদ্দেশ্যে বলেন যে গাছটির হাড়ি ভেঙ্গে দিয়েছিল এটি সেই গাছেরই আম । পরবর্তীতে এই গাছ টি হাড়িভাঙ্গা গাছ, এবং আমের জাতের নাম ও হাড়িভাঙ্গা হয়ে যায়।
বিশাল জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হলো। এবার আমের সম্পর্কে কিছুটা জানা যাক। হাড়িভাঙ্গার উপরের অংশ সালমান খানের মত কিন্তু নিচের অংশ যেন রনবীর কাপুর। আমটি খুবি মাংসালো, শ্বাস গোলাকার ও একটু লম্বা । আমের তুলনায় শ্বাস অনেক ছোট, ভিতরে আঁশ নেই । আকারের তুলনায় অন্য আমের চেয়ে ওজনে কিছুটা বেশী। গড়ে ৩টি আমে ১ কেজি হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে একটি আম ৫০০/৭০০ গ্রাম হয়ে থাকে। পুষ্ট আম বেশী দিন অটুট থাকে।
কাচা অবস্থায় গাড় সবুজ, কিন্তু পাকার পর রং হলুদাভ হয়। সাধারণত জুনের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে এই আম গাছ থেকে পাড়া হয়। এই আম কে কিশোর কিশোরীর সাথে তুলনা করা যায়। কিশোর কিশোরীদের যেমন বেশী পক্ক হওয়া ঠিক না, এই আমের ক্ষেত্রেও এই নীতি প্রযোজ্য। তবে বেশী পক্ক হলে চামড়ায় রিংকেল পড়ে, কিন্তু ভিতর টা সালমা হায়েকের মতোই তরুণ থাকে।
৪) ল্যাংড়া আম
নিক ফিউরিকে চিনেন না, এমন ম্যুভি লাভার খুঁজে পাওয়া ভাড়। যার এক চোখ না থেকেও শিল্ডের মতো দূর্ধর্ষ সিনেমার পরিচালনা করেছিলেন। পেঙ্গুইনকে তো চিনবেন, খোঁড়া হয়েও গোথাম সিটির অপরাধ জগতের সম্রাট ছিলো সে। ইতিহাস বিখ্যাত তৈমুর লংকে তো ভুলে যাওয়ার কথা না, খোঁড়া হয়েও বিশ্ববরেণ্য বিজেতা, পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার একচ্ছত্র অধিপতি।
আমের জগতেও রাজার মুকুট দখল করে আছে তৈমুর লং, নিক ফিউরির মত ডিফারেন্টলি এবল, ল্যাংড়া আম। এই আম রাজার মতৈ আমের মৌসুম শুরু করে, মৌসুমের ঠিক শুরুতেই বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে বেড়ায় এই ল্যাংড়া আম।
আরও পড়ুনঃ নিরাপদ ও জৈব উপায়ে আম উৎপাদনে ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি
- স্বাদ অক্ষুণ্ণ রেখে গোশত সংরক্ষণের উপায় - July 21, 2021
- পেঁয়াজের রোগ-বালাই ও এর দমন ব্যবস্থা – পর্ব ২ - July 18, 2021
- পেঁয়াজের রোগ-বালাই ও এর দমন ব্যবস্থা – পর্ব ১ - July 18, 2021