সমগ্র বিশ্বজুড়ে অর্কিডের নামডাক বেশ! অভিজাত শ্রেণির ফুলের কাতারে অর্কিডের অবস্থান। অর্কিড আর সৌন্দর্য ও স্নিগ্ধতা দিয়ে অনায়াসেই যে কাউকে বিস্মিত করে ফেলে। ছোটবেলায় Anacondas: The Hunt for the Blood Orchid ম্যুভি দেখতে দেখতে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কি আশ্চর্য এক ফুল, যেই ফুলকে অর্জন করতে লক্ষ লক্ষ মেইল পাড়ি দিয়ে একদল গবেষক এনাকোন্ডার মৃত্যুপুরীতে ফেঁসে যায়। তারপর একে একে মারা যেতে থাকে সঙ্গীরা। শেষমেশ ব্লাড অর্কিড জয় করেই ফেরে দুর্ধর্ষ সাহসী দল, কিন্তু হারিয়ে ফেলে অনেকগুলো প্রাণকে।
বাস্তবে অর্কিডকে জয় করতে আপনাকে মাইলকে মাইল পাড়ি দিতে হবে না, বাজি রাখতে হবে না জীবন। এখন বাংলাদেশেই অনেক অর্কিডের প্রজাতি চাষ হচ্ছে। কোনো কোনোটি চলে এসেছে আমাদের বারান্দা কিংবা ছাদেও। বেশিরভাগ সুন্দর জিনিসের মতো এগুলিকেও অনেক উচ্চ রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়।
সমস্তরকম অর্কিড জন্মানো কঠিন কিছু নয়। কিছু কিছু অর্কিড ব্যবহারিকভাবে অবিনাশীক্ষমতাসম্পন্ন। বেশিরভাগ অর্কিডই সরল পত্রবিশিষ্ট বহুবর্ষজীবী গুল্ম এবং সঠিক অবস্থায় বেড়ে উঠতে পারলে (তাপমাত্রা ১৬-১৭ ডিগ্রি এর চেয়ে কম নয়), ফুলসহ এরা আট সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। তারা কখনো কখনো পুনরায় ফুল দেয়। কখনই অর্কিডের বায়ুপূর্ণ শিকড় কেটে ফেলবেন না, কখনই নয়।
নতুনদের চ্যালেঞ্জ
অর্কিডের চাষ একটা আসক্তির মতো। তবে আপনি অর্কিডের সঠিক যত্ন তখনই নিতে পারবেন, যখন আপনি এর প্রজাতি সম্বন্ধে অবগত হবেন। নার্সারিগুলিতে পাবেন এমন বেশিরভাগ অর্কিডগুলি হাইব্রিড, বিশেষত ফুলের জন্য তৈরি। এদেরকে বাড়ি এবং অফিসে যত্ন নেওয়া খুবই সহজ। তবে আলো এবং আর্দ্রতার মতো কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখা উচিত। আপনি যদি কোনও গাছের প্রাকৃতিক আবাসের মত অবস্থা তৈরি করতে পারেন তবে অর্কিডে অনায়াসেই সাফল্য লাভ করবেন। আরও পড়ুনঃ ছাদবাগানে কোকোপিটের প্রয়োজনীয়তা
যেসব অর্কিড নতুনদের জন্যে সহজসাপেক্ষ
এপিফাইটিক ও টেরেস্ট্রিয়াল আমাদের দেশে সহজলভ্য়। এই অর্কিডগুলি জনপ্রিয় কারণ এরা বাড়িতে ভাল জন্মায়। এপিফাইটিক হলো পরজীবি উদ্ভিদ অর্থাৎ অন্য কোনো বড় গাছের উপর নির্ভর করে বেছে থাকে। আর টেরেস্ট্রিয়াল অর্কিড মাটিতেই জন্মায়। তাই বাসায় লাগানোর জন্য টেরেস্ট্রিয়াল অর্কিডই সুবিধাজনক।
মাটি
নতুন অর্কিড বাগানীরা প্রায়শই যেই ভুল করে তা হল, অর্কিডকে অন্যান্য প্রস্ফুটিত ফুলের মতো মাটিতে পট করা দরকার। এটি একটি গুরুতর ভুল। বেশিরভাগ অর্কিডের শিকড় বায়ুথলি সমৃদ্ধ, এরা পরিবেশ থেকে বায়ুথলির সাহায্যে বাতাস নেয়। যা কিনা মাটি দিয়ে পট করা অর্কিডকে বাধাগ্রস্থ করে। সুতরাং পটিং মিক্স ও কোকোডাস্ট দিয়ে পট তৈরি করুন।
আলো
সরাসরি সূর্যালোক এড়িয়ে চলা উচিত। কিছু সাধারণ ধরণের অর্কিড আছে যা উজ্জ্বল আলোতে প্রস্ফুটিত হয়, অন্যদিকে Phalaenopsis এবং Pahiopedilum কম আলোতে থাকতে পছন্দ হয়। অর্কিডগুলি যতটা আলো সহ্য করতে পারে ততটুকু আলোই নিশ্চিত করা উচিত। এক্ষেত্রে আপনার অর্কিডটি কেমন আলো সহ্য করতে পারবে, তা জেনে নিন। ঘন এবং খাড়া পাতাবিশিষ্ট জাত পাতলা ও অনুভূমিক পাতাবিশিষ্ট অর্কিডের জাতের চেয়ে বেশি আলো সহ্য করতে পারে। খুব কম আলো প্রদান করা অর্কিড চাষে প্রাথমিক ভুলগুলির মধ্যে অন্যতম একটি ভুল।
তাপমাত্রা
উষ্ণতা প্রিয় অর্কিডগুলো দিনের তাপমাত্রা ২১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং ২৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে বেড়ে ওঠে। এর মধ্যে ফ্যালেনোপসিস অর্কিড অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সাধারণত নার্সারিগুলিতে বিক্রি হওয়া অর্কিডগুলি বেশিরভাগই উষ্ণতাপ্রিয় হয়ে থাকে।
আর্দ্রতা
বেশিরভাগ অর্কিডগুলি বায়ুমণ্ডলের প্রায় ৭০ শতাংশ আর্দ্রতা পছন্দ করে যা আমাদের বেশিরভাগ ঘরের তুলনায় অনেক বেশি। সুতরাং, অর্কিডকে অতিরিক্ত আর্দ্রতা সরবরাহ করার চেষ্টা করতে হবে। অর্কিডের জন্যে সাধারণত স্প্রে বোতল দিয়ে কৃত্রিম আর্দ্রতা তৈরি করাই ভাল। যদি উদ্ভিদের শিকড়গুলির বায়ুথলি পাত্রের থেকে বেড়ে বাইরে চলে আসে, তবে সেই শিকড়গুলির জন্যে কিছুটা আর্দ্রতার দরকার হবে। বাড়িতে আপনি একটি ট্রেতে ছোট ছোট চারা রোপন করতে পারেন। পানি এবং নুড়ি দিয়ে এটি পূরণ করে নিন। পানি বাষ্পীভূত হয়ে এটি অর্কিডে কিছুটা অতিরিক্ত আর্দ্রতা সরবরাহ নিশ্চিত করবে। এই কৌশলটি নিঃসন্দেহে খুবই কার্যকরি।
পুষ্টি
অর্কিড বৃদ্ধির জন্য নাইট্রোজেন, সালফার, ফসফরাস, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের প্রয়োজন। শীতকালে অর্কিডের বৃদ্ধি কমে যাওয়ার কারণে বিভিন্ন জাতের ক্ষেত্রে সার দেওয়ার হার বিভিন্নরকম হয়ে থাকে। নিচে কিছু জাতের কথা উল্লেখ করা হলঃ
পানি
বেশি পানি সেচ দেওয়া কখনোই ভাল না। কম পানি দিলেও অর্কিড বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ভাল। বেশি পানি দিলে গাছ নিশ্চিত মারা যাবে। অর্কিডের মিডিয়াম হিসেবে পটিং মিক্স ব্যবহার করলে এটিই প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করবে। বেশিরভাগ অর্কিডই এমনভাবে তৈরি করা হয়, যেটিতে সপ্তাহে একবার পানি দেওয়াই যথেষ্ট। মাটি শুকিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত পানি দিবেন না। অর্কিডকে পানি দেওয়ার আগে পাত্রটি কয়েক সেকেন্ডের জন্য একটি বালতিতে ডুবিয়ে রাখুন, তারপরে এটিকে উত্তোলন করুন এবং অতিরিক্ত পানি ঝেরে ফেলুন। ব্যস, হয়ে গেল।
প্রুণিং
নতুনরা প্রায়শই কীভাবে অর্কিড ছাঁটাই করতে হয় তা নিয়ে খুব একটা ওয়াকিবহাল নয়।
পুরানো বাদামী হওয়া ডালগুলি ছাঁটাই করা ভাল। যদি এর ডালপালাগুলো এরপরও সবুজ রয়ে যায়, তবে এটি আবার বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করবে, কয়দিনের মধ্যে নতুন ডালপালাও গজাবে। অর্কিডের প্রুণিং কেবলমাত্র পাতা, শিকড় বা ডাল কর্তনের জন্যেই করা উচিত যা ইতিমধ্যে মারা গেছে বা বাদামী হয়ে গেছে, এ ছাড়া আর নয়। আপনার কাটার সরঞ্জামগুলি ব্যবহারের পূর্বে জীবানুমুক্ত করে নিতে হবে বা ধ্বংস করে ফেলতে হবে যাতে অর্কিডে রোগ ছড়িয়ে না পড়ে। যখন নতুন শিকড় বাড়তে শুরু করবে পুণরায় পাত্রে নিয়ে আসতে হবে।
- বাংলাদেশে পঙ্গপাল আক্রমণের সম্ভাবনা - July 10, 2020
- রকমেলন চাষ ও এর পরিচর্যা - July 6, 2020
- ঘরোয়া উদ্ভিদের রোগ-বালাই নিয়ন্ত্রণ – দ্বিতীয় পর্ব - July 3, 2020