খাবারে নতুনত্ব কার না পছন্দ? কিন্তু এমন খাবার খুব কমই আছে যাতে একইসাথে আছে সুস্বাদু খাবারের গুন এবং স্বাস্থ্যকর ডায়েট। আর এগুলো সবই একত্রে পাবেন মাইক্রোগ্রিন(Microgreen)-এ।
কী, আগে শুনেননি, মাইক্রোগ্রিনের ব্যাপারে? তাহলে চলুন জেনে নেই, কী এই মাইক্রোগ্রিন।
মাইক্রোগ্রিন কী?
মাইক্রোগ্রিন হলো বীজ থেকে সদ্য জন্মানো ছোট ছোট উদ্ভিদ। আশির দশকের দিকে ক্যালিফোর্নিয়ার রেস্তোরার শেফরা বা যাদের আমরা বাবুর্চি হিসেবে চিনি, তারা এর প্রচলন শুরু করেন। তখন তারা দশ থেকে চৌদ্দ দিন বয়সী গাছগুলোকে যেগুলোর মধ্যে সদ্য ২-৩টি পাতা সবে গজিয়েছে মাত্র, সেগুলো মাটি থেকে তুলে শিকড় বাদ দিয়ে খাবারে পরিবেশন করত। তখন শুধুমাত্র খাবার সাজানোর কাজে ব্যবহার করা হলেও পরে এর গুণাগুন নিয়ে গবেষণা করা হয়। গবেষণায় এর পুষ্টিগুন নিয়ে নানা তথ্য উঠে আসে এবং অনেকে একে মাত্রদুগ্ধ এর সাথেও তুলনা করে থাকেন। সদ্য অঙ্কুরিত এসব গাছের মধ্য লুকিয়ে থাকে অসংখ্য পুষ্টিগুণ। সুতরাং বলা যায়, সদ্য জন্ম নেয়া দু- তিন ইঞ্চি লম্বা এসব ক্ষুদ্র উদ্ভিদই হল মাইক্রোগ্রিন।
চাষ পদ্ধতি
এসব ক্ষুদ্র উদ্ভিদ বাজারে কমবেশি ঋতু নির্ভর,যদি আমরা এগুলোকে নিজ নিজ বাড়িতেই চাষ করে নিতে পারি, তাহলে কিন্তু মন্দ হয় না। খুব বেশি কিছুর দরকারও নেই সেজন্য, একটু পরিচর্যা আর পরিকল্পনাই যথেষ্ট।
আসুন জেনে নিই, বাড়িতে এ ক্ষুদ্র সবজিগুলো লালন করতে আমাদের যা যা লাগছে-
১) চাষ করার জন্য ট্রে(যেকোনো আকারের),
২) মাটি,
৩) বীজ ও
৪) পানি দেয়ার জন্য হস্তচালিত স্প্রেয়ার।
মাইক্রোগ্রিন রোপন পদ্ধতি
ক) প্রথমে মাটি দিয়ে ট্রে ভর্তি করে নিন।
খ) গাছের বীজগুলো একটু সাজিয়ে বিছিয়ে দিন।
গ) এরপর স্প্রেয়ার দিয়ে আস্তে পানি ছিটিয়ে দিন।
ঘ) ট্রে রোদে রাখার প্রয়োজন নেই,ঘরের ভেতরেই রাখুন।
ঙ) যখন চারা গাছ জন্মাবে তখন ই কেবল রোদে ট্রে রাখবেন।
এখানে কিছু বিষয় খেয়াল রাখা খুবই জরুরী, সেগুলো হলো-
ক) মাইক্রোগ্রিনের ক্ষেত্রে দু’ধরনের বীজ হয়। এক ধরনের বীজ মাটিতে বোনার আগে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। অন্যটার ক্ষেত্রে তা সরাসরি বুনলেই চলে।
খ) পূর্বেই সিক্ত করা বীজের ক্ষেত্রে এক গ্লাস পানিতে বীজ ভরে মসলিন কাপড় দিয়ে ঢেকে দিন। রাবার ব্যান্ডের সাহায্যে গ্লাসের মুখ আটকে দিন। সারারাত, নিদেন পক্ষে ৯-১০ ঘণ্টা এভাবে রাখুন। পরদিন বীজ ধুয়ে পানি ফেলে গ্লাসেই রাখুন, যতক্ষণ না অঙ্কুরোদগম হচ্ছে। প্রতি ৪-৫ ঘণ্টা অন্তর এক বার করে বীজ ধুয়ে নিতে পারেন। এতে পঁচনের হাত থেকে বীজ রক্ষা করা যাবে। অঙ্কুরোদগম হওয়া মাত্রই বীজ মাটিতে বুনে ফেলবেন। এবার ট্রে সূর্যের আলোয় অর্থাৎ বারান্দা বা জানালার ধারে রাখতে পারেন। গোটা পদ্ধতিতে মাটিতে অন্তত ৪৫ শতাংশ ময়শ্চারাইজ়ার বা আর্দ্রতা রক্ষা করা উচিত।
গ) অন্য বীজের ক্ষেত্রে ভিজিয়ে রাখার দরকার নেই। সরাসরি বীজ লাগান। তবে কড়া সূর্যের আলোয় ট্রে রাখবেন না। স্প্রেয়ারের সাহায্যে দিনে দু’বার পানি স্প্রে করবেন।
ঘ) একই মাটিতে অন্তত দু’বার মাইক্রোগ্রিন বুনতে পারেন। এর জন্য এক বার বেবি গ্রিন কাটা হয়ে গেলে মাটির তলার শিকড় বের করে ফেলুন। তার পরে লাগাতে পারেন নতুন বীজ।
ঙ) জায়গা বাঁচাতে একই ট্রে ব্যবহার করুন একাধিক মাইক্রোগ্রিন চাষের জন্য। সে ক্ষেত্রে ট্রে ভাগ করে নিন কয়েক ভাগে। প্রতি ভাগের মাঝে একটি করে আইসক্রিমের চামচ পুঁতে তাতে বীজের নাম লিখে রাখতে পারেন।
এবার জেনে নিই, কোন বীজগুলো সরাসরি লাগানো যাবে, আর কোনগুলো পূর্বে ভিজিয়ে নিতে হবে-
ক) ভিজিয়ে রাখা দরকারঃ জোয়ান, আলফাআলফা, বিট, ব্রকোলি, বাঁধাকপি, চানা ডাল, মেথি, মৌরি, রোজ়েলা, কচু, কড়াইশুঁটি, মূলো, পালং, সূর্যমুখী, শালগম, অমরান্থ ইত্যাদি।
খ) সরাসরি বুনলে চলেঃ আরুগুলা, বেসিল, ধনে, তিসি, বেশির ভাগ সরষে, ওয়াটারক্রেস ইত্যাদি
মাইক্রোগ্রিনের পুষ্টি উপাদান
১) মাইক্রোগ্রিন পুষ্টি উপাদানে ভরপুর একটি খাবার। এতে রয়েছে পটাশিয়াম, কপার, জিংক, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম ইত্যাদি।
২) মাইক্রোগ্রিনে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে এন্টিঅক্সিডেন্ট।
৩) এছাড়াও পরিণত উদ্ভিদের চেয়ে অধিক পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ লবণ ও এন্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে এতে।
মাইক্রোগ্রিন এর উপকারিতা
১) পুদিনাঃ হজম ও মুখের সমস্যা মোকাবিলা করা ছাড়াও পুদিনা হতাশা দূর করার কাজে অনবদ্য।
২) হলুদঃ কাঁচা হলুদের মতোই টারমারিক মাইক্রোগ্রিন অনবদ্য। নিউরোটক্সিন, ক্যান্সার, বদহজম, কোলেস্টেরলের সমস্যা ছাড়াও হলুদ অ্যান্টি ফ্লেমেটারি। ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বাড়ায় হলুদ। সামান্য গোলমরিচের সঙ্গে মিশিয়ে টারমারিক মাইক্রোগ্রিন খেলে তার উপকার বাড়ে বহু গুণ।
৩) কারিঃ রান্নায় শুধু ফোড়ন হিসেবেই নয়, কাঁচা খেতে পারেন এই কারি মাইক্রোগ্রিন। চুল মজবুত করতে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এবং শরীরের যত্ন নিতে সাহায্য করে এই মাইক্রোগ্রিন।
৪) ব্রাহ্মীঃ ছোটবেলায় ঘিয়ে ভেজে ব্রাহ্মী শাকের পাতা খেয়েছেন অনেকেই। মাইক্রোগ্রিনের তালিকায় একদম গো়ড়ার দিকে রয়েছে ব্রাহ্মীর নাম। স্মৃতিশক্তি বাড়ানো ছাড়াও গ্যাস্ট্রিক আলসার, স্ট্রেস কমানো, শ্বাসযন্ত্রকে ভাল রাখে ব্রাহ্মী।
মাইক্রোগ্রিনের স্বাস্থ্য উপকারিতা
১) হৃদপিন্ডের অসুখ
মাইক্রোগ্রিনে আছে পলিফেনল নামক এন্টিঅক্সিডেন্ট, যেটি হৃদপিন্ডের অসুখের ঝুকি কমায়। এছাড়াও মাইক্রোগ্রিন ট্রাইগ্লিসারাইড ও খারাপ LDL(Low Density Lypoprotein) কমাতে সাহায্য করে।
২) আলঝেইমার
এছাড়াও পলিফেনল নামক এন্টিঅক্সিডেন্ট টি আলঝেইমার প্রতিরোধে সাহায্য করে যা প্রচুর পরিমাণে মাইক্রোগ্রিনেই বিদ্যমান।
৩) বহুমুত্র বা ডায়েবেটিস
এন্টিঅক্সিডেন্ট স্ট্রেস কমিয়ে রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। গবেষণায় প্রমাণিত যে, মাইক্রোগ্রিন আমাদের দেহের কোষকে ২৫-৪৪% বেশি শর্করা গ্রহণ করতে উদ্দীপ্ত করে।
৪) ক্যান্সার
এন্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ফল ও সবজি বিভিন্ন প্রকার ক্যান্সার হতে আমাদের রক্ষা করে। পলিফেনল সমৃদ্ধ কাবারগুলো এক্ষেত্রে বেশি কার্যকরী।
মাইক্রোগ্রিনের উপকারিতা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। সবধরনের খাবারের সাথে কিংবা সালাদ হিসেবে অথবা আপনি নিজের মত করেই বানিয়ে খেয়ে নিতে পারেন এসকল ক্ষুদ্র উদ্ভিদ এবং স্বল্প খরচে বাড়িতেই আমরা মাইক্রোগ্রিনের চাষ করে নিতে পারি।
- স্বাদ অক্ষুণ্ণ রেখে গোশত সংরক্ষণের উপায় - July 21, 2021
- পেঁয়াজের রোগ-বালাই ও এর দমন ব্যবস্থা – পর্ব ২ - July 18, 2021
- পেঁয়াজের রোগ-বালাই ও এর দমন ব্যবস্থা – পর্ব ১ - July 18, 2021