ফসল উৎপাদনের জন্য ইউরিয়া বা নাইট্রোজেন জাতীয় সার ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে ইউরিয়া সারের দাম বাড়ার ফলে ফসলের উৎপাদনের খরচ তুলনামূলকভাবে বেড়ে গেছে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে ইউরিয়ার উৎপাদন ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। ফলে এর দামও বেড়ে যাচ্ছে। সরকার প্রতি বছরই সারের জন্য ভর্তুকি দিচ্ছে। তবুও কৃষক কাঙ্ক্ষিত লাভের মুখ দেখতে পারছে না। সেজন্য ভবিষ্যতে যেন চাষীরা কম ইউরিয়া সার ব্যবহার করে এবং এই সারের বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন উপযুক্ত সময় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইউরিয়ার পরিবর্তে এজোলা নামক শ্যাওলাটি ব্যবহার করে ইউরিয়ার চাহিদা পুরণ করা সম্ভব। ইউরিয়া সার ব্যবহারের ফলে ফসলের উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ার সাথে সাথে মাটির উর্বরতা নষ্ট করে, পরিবেশ দূষণ করে; সর্বোপরি ইউরিয়া সার একটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। অপরদিকে, এজোলা প্রাকৃতিকভাবে তৈরী উন্নত মানের নাইট্রোজেন জৈব সার। এজোলা উৎপাদনে খরচ কম লাগে, ফসলের উৎপাদন খরচ কমবে, মাটির গুণাগুণ ভালো থাকবে, মাটির উর্বরতা বহুগুণে বাড়বে, পরিবেশ ভালো থাকবে, ইউরিয়া সারের জন্যে সরকারের প্রদেয় ভর্তুকি খরচ দেয়া লাগছে না, সর্বোপরি উপকারি।
এছাড়াও হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশুর জন্যে একটি উৎকৃষ্ট খাদ্য। এজোলা বর্জ্য পানি পরিশোধনে ভুমিকা পালন করে। প্রতি বছর দেশে ইউরিয়া লাগে প্রায় ৩০ লক্ষ মেট্রিক টন। বাংলাদেশের সর্বত্র এজোলা উৎপাদনের উপযোগী পরিবেশ রয়েছে।
পরিচিতি
আমাদের দেশে প্রায় সব অঞ্চলেই এজোলা জন্মে। এটি তেঁতুলিয়া পানা, ক্ষুদিপানা, বুটি পানা, কুটিপানা ইত্যাদি নামে পরিচিত। এজোলা ফার্ন জাতীয় এক ধরণের ক্ষুদ্র জলজ উদ্ভিদ। এটি ধান ক্ষেত, পুকুর, ডোবা, খাল, বদ্ধ পানি ও নদীর পানিতে জন্মে। এর ভাসমান গুচ্ছগুলো ত্রিকোণাকার। প্রতিটি গুচ্ছের দৈর্ঘ্য ১০-১৫ মিল. এবং প্রস্থে ১০-১২ মিলি। ভাসমান গুচ্ছের প্রধান কান্ডের উভয় দিক থেকে শাখা বের হয় ৮-৯ টি। প্রতিটি শাখায় ১০-১২ টি পাতা উভয় দিকে একটির পর একটি সাজানো থাকে। প্রতিটির দৈর্ঘ্য ১-১.৫ মিমি প্রস্থ ০.৫-০.৭ মিমি এবং পাতাগুলো বেশ পুরু। পাতার নিম্নাংশ স্বচ্ছ ও পানিতে ডুবে থাকে এবং উপরের অংশ সবুজ ও পানির উপরে ভাসমান থাকে। কান্ডের নিচে ১০-২০ মিমি পর্যন্ত শিকড় গজায়।
বংশ বৃদ্ধি
এজোলা বংশ বৃদ্ধি করে যৌন (বীজ) ও অযৌন(অঙ্গজ) উভয় পদ্ধতিতে । পানিতে ভাসমান অবস্থায় এজোলার বংশবৃদ্ধি ভালো হয়। কাদামাটিতে এজোলা বেঁচে থাকতে পারে। সাধারণত ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ইহার অঙ্গজ বংশ বিস্তার দ্রুত হয়। তাপমাত্রা বেশি হলে যেমন চৈত্র-বৈশাখ মাসে প্রচন্ড গরম ও প্রখর রোদে এজোলা বংশ বৃদ্ধি করে না, তবে বেঁচে থাকে। প্রতিকূল আবহাওয়ায় পাতার নিচের দিকে কিছু স্পোর তৈরি করে দীর্ঘদিন যে কোন পরিবেশে বেঁচে থাকে। পরে উপযোগী পরিবেশ পেলেই যৌন প্রক্রিয়ায় বিস্তার লাভ করে। বর্ষাকালে স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া এজোলার জন্য সবচেয়ে উপযোগী।
আরও পড়ুনঃ ঘরেই তৈরি করুন কোকোপিট
সার হিসেবে এজোলার গুরুত্ব
সার হিসেবে এজোলাকে আশ্রয় করে একটি নীলাভ সবুজ শেওলা এজোলার পাতার ভেতরে একটি গর্তে অবস্থান করে এবং বড় হয়। পাতার ভেতরেই শ্যাওলাটি বংশ বৃদ্ধি করতে পারে। পাতার ভেতরে নীলচে সবুজ শ্যাওলার একটি মাত্র প্রজাতি (এনাবিনা) থাকে। এজোলার প্রতিটি পাতায় এনাবিনা থাকে ৭৫ হাজার । শেওলাটি বাতাস থেকে ৩-৩.৫% নাইট্রোজেন আহরণ করে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় এমোনিয়া তৈরির মাধ্যমে নিজের ও আশ্রয়দাতা এজোলার জন্য নাইট্রোজেন পুষ্টি যোগায়। উল্লেখ্য, গাছ ইউরিয়া সারের মুল উপাদান নাইট্রোজেনকে এমোনিয়াম আয়ন হিসেবে গ্রহণ করে। এজোলা প্রতিদিন প্রতি হেক্টরে এক টন কাঁচা জৈবসার তৈরি করতে পারে। একই সঙ্গে বাতাস থেকে ২ কেজি নাইট্রোজেন আহরণ করতে পারে যা ৫ কেজি ইউরিয়া সারের সমান। একস্তর এজোলা যখন পানির উপরিভাগে সম্পূর্ণরূপে ঢেকে ফেলে তখন প্রতি হেক্টরে ১০-১৫ টন কাঁচা জৈব সার ও সেই সঙ্গে ২০-২৫ কেজি নাইট্রোজেন আহরিত হয় যা ৪৫-৫৫ কেজি ইউরিয়া সারের সমান। কাঁচা এজোলায় শতকরা ৬ ভাগ শুকনো বস্তু থাকে।
এতে শতকরা-
৩-৪ ভাগ নাইট্রোজেন,
পটাশিয়াম ০.২৫-৫.৫ ভাগ,
ক্যালসিয়াম ০.৪৫.১.২৫ ভাগ,
সিলিকা ০.১৫-১.২৫ ভাগ
সোডিয়াম ০.১৫-১ ভাগ
ফসফরাস ০.১৫.১ ভাগ,
ক্লোরিন ০.৫-০.৭৫,
সালফার ০.২ -০.৭৫ ভাগ,
ম্যাগনেসিয়াম ০.২৫-০.৫ ভাগ
এলুমিনিয়াম ০.০৪-০.৫ ভাগ,
আয়রন ০.০৫-০.৫ ভাগ,
ম্যাঙ্গানিজ ৬০-২৫০০ পিপিএম,
কপার ২-২৫০ পিপিএম ও
জিংক ২৫-৭৫০ পিপিএম।
এজোলা মাটির সাথে মিশিয়ে দিলে এগুলো পচে সবই গাছের পুষ্টি হিসেবে গ্রহণ করে। অর্থাৎ এজোলা উন্নতমানের মিশ্র জৈব সার। এক হেক্টর বোরো ও আমন ধানের জমিতে এজোলা ব্যবহার করলে বাকি ২০-৩০ কেজি ইউরিয়া দিলেই নাইট্রোজেনের সম্পূর্ণ চাহিদা পূরণ হবে।
ভাসমান এজোলা
ভারত, চীন, থাইল্যান্ড সহ বিভিন্ন দেশের কৃষকরা ধানক্ষেতে জীবাণু সার হিসেবে এজোলার চাষ করে। এজোলা ধান গাছে নাইট্রোজেনের চাহিদা পুরণ করে এবং জৈব পদার্থ মিশে মাটির উর্বরতা বাড়ায়। আমাদের দেশে বোরো ও আমনের জমিতে প্রাকৃতিক ভাবেই এজোলা জন্মে। কৃষকরা না জানার ফলে আগাছা মনে করে জমি থেকে পরিস্কার করে ফেলে দেয়। অথচ এজোলা মাটির সাথে মিশিয়ে দিলেই ১৫ দিনের মধ্যে তা পচে গিয়ে মাটিতে নাইট্রোজেন সরবরাহ করবে। অন্যান্য ফসলী জমিতে এজোলা মাটির সাথে মিশিয়ে ইউরিয়া সারের চাহিদা পূরণ করা যায়। রোপা ধানে এজোলা ব্যবহার করে ২০-২৫ ভাগ ফলন বাড়ানো যায়।
জৈব আগাছা নাশক হিসেবে এজোলার গুরুত্ব
এজোলা পানির উপরিভাগ ঢেকে রাখে বিধায় সূর্যের আলো পানির নিচে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে আগাছা জন্মাতে পারে না। এতে শ্রমিকের খরচ সাশ্রয় হয়।
প্রাণীর খাদ্য হিসেবে এজোলার গুরুত্ব
এজোলা হাঁস মুরগি ও গবাদিপশুর, মাছের খাদ্য তৈরিতে ব্যবহার হয়। এজোলাতে প্রচুর আমিষ ও চর্বি থাকায় উচ্চমানের খাদ্য তৈরি হয়। রাসায়নিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, এজোলাতে
আমিষ ২০-২৫%,
অ্যাশ ১০%,
শ্বেতসার ৬-৬.৫%,
চর্বি ৩-৩.৫%,
দ্রবীভুত সুগার ৩-৩.৫% ও
ক্লোরোফিল ০.২৫- ০.৫%।
এজোলা তৈরি খাদ্যে মুরগির ডিমের উৎপাদন বাড়ায়, কুসুম গাঢ় হলুদ বর্ণ হয়, ডিম ও মাংসে বেশি আমিষ থাকে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। গবাদি পশুর দৈহিক বৃদ্ধি ও দুধ উৎপাদন বাড়ে। মাছ চাষে পুকুরে পানি বিশুদ্ধ রাখে ও মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এজোলা দিয়ে পশু পাখি খাদ্য ও মাছের উৎপাদনে খরচ কম হয়।
বর্জ্য পানি পরিশোধনে এজোলার গুরুত্ব
প্রিজম বাংলাদেশ নামের একটি এনজিও টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের কুমুদিনী হাসপাতালের বর্জ্যপানিতে এজোলা চাষ করে পানি পরিশোধন করে আসছে। পরিশোধিত পানি কৃষিকাজ ও মাছ চাষে ব্যবহার করা হয়েছে। এজোলা বর্জ্য পানিতে বিদ্যমান ক্ষতিকর উপাদানসমূহ সক্রিয়ভাবে দূরীভুত ও শোষন করতে পারে। বর্জ্য পানি পরিশোধনের পর এই এজোলা জমিতে ব্যবহার করা যায়।
এজোলা উৎপাদন
এজোলা উৎপাদন ও গবেষণা হয়েছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনষ্টিটিউট ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে । খাল, বিল, মজা পুকুর, ডোবা, নালা, হাওড়-বাওড়ে এজোলা চাষ করা যায়। এছাড়াও বোরো ও আমন ক্ষেতেও চাষ করে মাটির সঙ্গে মিশানো যায়। প্রাথমিক ভাবে প্রতি বর্গমিটারে ১০০-২০০ গ্রাম সতেজ এজোলা বীজ হিসেবে জলাশয় অথবা ধানের জমিতে ছড়িয়ে দিতে হবে। সেই সাথে প্রতি হেক্টরে ৮-১০ কেজি, টিএসপি ৮-১০ কেজি ,১৫-২০ দিন পর পর প্রয়োগ করতে হবে। উপযুক্ত পরিবেশে ১০-২০ দিনের মধ্যে এজোলা অঙ্গজ বংশ বিস্তার করে জমিতে বা পানিতে একটি স্তর তৈরি করে। এজোলা উৎপাদনের জন্য ধানের চারা রোপনের ৫-৭ দিন পর বীজ হিসেবে ১০০-১২০ গ্রাম সতেজ এজোলা জমিতে ছিটাতে হবে। ১৫-২০ দিন পর পর জমির মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয় অথবা উঠিয়ে অন্য জমিতে ব্যবহার করা যায়।
সংরক্ষণ
সারা বছর এজোলার বীজতলা সংরক্ষণ করা যেতে পারে। পুকুর,ডোবা বা বদ্ধ জলাশয়ে সংরক্ষণ করা যায়। অতি বৃষ্টি ও রোদ থেকে রক্ষার জন্য শাকসবজির মাচা করা যেতে পারে। বীজতলায় সর্বদা ৫-১০ সেমি পানি থাকতে হবে।। প্রতি বর্গমিটার বীজতলার জন্য ৮-১০ দিন পর পর ১ গ্রাম টিএসপি দিতে হবে। শামুক ও পোকার কীড়া এজোলার ক্ষতি করে। শামুক বেছে ফেলে দিতে হবে। এই পোকা দমনের জন্য কার্বোফুরান স্প্রে করা যেতে পারে।
এজোলা দেশের মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। এ প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগালে ইউরিয়ার বিকল্প ব্যবস্থা হবে, ফসল ফলানোর খরচ সাশ্রয় হবে, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট দূর হবে, ফলন বৃদ্ধি, পরিবেশ দূষণ রোধ করা, ফসল মাছ গবাদিপশু ডিম ও দুধের উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য এজোলা বিরাট ভূমিকা পালন করবে। এজোলা ব্যবহারের ফলে যে ইউরিয়া আমদানি হত তা দেশের জন্য বছরে শতশত কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। এজোলা ব্যাপক হারে ব্যবহার করার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠান, কৃষি ভিত্তিক এনজিও সহ সকলের উদ্যোগ প্রয়োজন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে একটি প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। সেই সাথে প্রচার প্রচারনার জন্য, কৃষি তথ্য সার্ভিস সহ সরকারি ও বেসরকারি মিডিয়াদের আগ্রণী ভূমিকা পালন করা উচিত।
কৃতজ্ঞতায়ঃ ফসলি
- স্বাদ অক্ষুণ্ণ রেখে গোশত সংরক্ষণের উপায় - July 21, 2021
- পেঁয়াজের রোগ-বালাই ও এর দমন ব্যবস্থা – পর্ব ২ - July 18, 2021
- পেঁয়াজের রোগ-বালাই ও এর দমন ব্যবস্থা – পর্ব ১ - July 18, 2021