বিশেরও অধিক পরিবেশ বিজ্ঞানী, গবেষক এবং সমাজবিজ্ঞানী একত্রিত হয়েছিলেন এমন কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে যেগুলোর প্রতি এখন খুব কম গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে কিন্তু ভবিষ্যতে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের উপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
(দ্রষ্টব্যঃ ১৫ টির মধ্যে ১০ টি টপিক অনুবাদ করা হয়েছে যেগুলোর সাথে বাংলাদেশ কোন না কোন ভাবে সম্পর্কিত)
ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিভাগের অধ্যাপক উইলিয়াম সাদারল্যান্ড এর নেতৃত্বে গবেষক দলটি এরকম ১৫ টি ট্রেন্ড এর কথা বলেছেন যেগুলো অদূর ভবিষ্যতে পরিবেশের ওপর ভালো কিংবা খারাপ দুরকম ভূমিকাই রাখতে পারে।
গবেষকরা বলছেন এই লেখাটির মাধ্যমে আমরা কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর আলোকপাত করতে চাই যেগুলোর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হওয়া উচিত। যাতে ভবিষ্যতে আরো সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি এবং বিদ্যমান সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়।
এন্টার্কটিকার লবণ-জল
আমরা যেরকম ভেবেছিলাম তারও বেশি গতিতে এন্টার্কটিকার বরফ গলছে। স্বাভাবিকভাবেই এর ফলে উপকূলবর্তী এলাকায় লবণাক্ততা বাড়বে, সাগরতলে এমন কিছু পদার্থের পলল হবে যেগুলোর কারণে মারা যাবে গভীর সাগরে থাকা প্রাণীকুল। ক্ষতিগ্রস্থ হবে ক্ষুদ্র উদ্ভিদ ও প্রাণিকণা সেইসাথে পরিবর্তন হবে বাস্তুসংস্থানের।
এসমস্ত ঘটনার ফলশ্রুতিতে পরিবেশের কার্বন ডাই অক্সাইড এর আদান প্রদান প্রভাবিত হবে এবং জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তন হবে। কিছু কারণে পরিবেশে কার্বন ডাই অক্সাইড এর পরিমাণ কমে যাবে এবং কিছু কারণে বাড়বে। তবে কার্বন চক্রের ওপর ঠিক কি প্রভাব পড়বে সে সম্পর্কে এখনো সুস্পষ্টভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়।
অভূতপূর্ব পারদ-পাহাড়
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে ভূগর্ভস্থ চিরহিমায়িত অঞ্চলে ১৬ লাখ মেট্রিক টনেরও বেশি পারদ জমা হয়ে আছে, যা কিছু পূর্বের অনুমানের চেয়ে অনেক বেশি এবং ভূপৃষ্ঠে পাওয়া পারদের তুলনায় দ্বিগুণ বেশি।
যেহেতু হিমায়িত অঞ্চলগুলো গলে যাচ্ছে এবং অধিক পরিমাণে পারদ পানিচক্রের সাথে মিশে যাচ্ছে ও অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে যাচ্ছে। পারদ পশুপাখি, গাছপালা এবং মানুষের জন্য ক্ষতিকারক, মস্তিষ্ক ও প্রজনন ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্থ হয় এই মৌলটির আধিক্যের ফলে। উদ্ভিদ ও অণুজীবের সাধারণ কার্যক্রম ও সম্পর্ক প্রভাবিত হয়, ফলে পুরো বিশ্বজুড়েই পারদের এই আধিক্য নেতিবাচকতা বয়ে নিয়ে আনবে।
প্লাস্টিকের বিকল্পঃ হতে পারে খাঁড়ার ঘা
প্লাস্টিকের ব্যাপারে সচেতনতার কারণে অনেক বিকল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে এ প্রযুক্তিগুলোর পরিপূর্ণ চক্র এবং শেষ পরিণতির বিষয়ে এখন পর্যন্ত তেমন কিছু গবেষণা করা হয় নি।
কিন্তু রিসাইকেল প্রক্রিয়ার যে পরিবর্তন আনা হয়েছে যেমন জীবপদার্থ দিয়ে প্লাস্টিক নিঃশেষ করার প্রযুক্তি, উদ্ভিদ থেকে প্লাস্টিকের বিকল্প প্রযুক্তি আবিষ্কার এসবই আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা, পানির ব্যবহার ও বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্যের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। শুধু তাই নয় এ প্রযুক্তিগুলোর উৎকর্ষতা কতটুকু সে প্রশ্ন তো থাকছেই, এগুলোর কারণে অন্য ভালো প্রযুক্তির ব্যবহার ও কমে যেতে পারে।
সানস্ক্রিন পরিবর্তনঃ পাল্টে দিতে পারে জলবায়ু
প্রচলিত সানস্ক্রিন ক্রিমগুলো সাগরের প্রবাল পাথরের জন্য ক্ষতিকর। একারণে সমুদ্রতীরে রোদ পোহাতে যাওয়া মানুষদেরকে সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মি থেকে বাঁচাতে বিজ্ঞানীরা এমন কিছু ধরনের সানস্ক্রিন আবিষ্কার করেছেন যেগুলোর পরিবেশের ওপর প্রতিক্রিয়া কম। ‘ শাইনোরিন’ এমনই একটি কার্যকরী পদার্থ যেটার বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সফল উৎপাদন হচ্ছে।
কিছু ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের ত্বক জ্বলে যাওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছে, তবে এ পদার্থটি ঠিক কিভাবে জৈবিকভাবে পরিবেশে নিঃশেষ হয় তা নিয়ে এখনো তেমন গবেষণা হয়নি। একারণে উপযুক্ত গবেষণা ব্যতিত শাইনোরিন যুক্ত সানস্ক্রিন যদি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয় তাহলে প্রবাল পাথরগুলো কিংবা সাগর তীরের পরিবেশ এক নতুন ধরনের প্রতিক্রিয়া এবং অজানা হুমকির সম্মুখীন হবে।
চীনের আরেক দুঃখঃ হোঙ্গি নদী
চীনের উত্তরাংশের সেচের জন্য ‘হোঙ্গি’ রিভার নামে একটি বৃহৎ খাল খনন করা হয়েছে। এটা এখনো নীতিগত অবস্থায়ই আছে। কিন্তু এ খালটির (পড়ুন নদী) আশপাশের এলাকা ও বহুদূরবর্তী অঞ্চলের বাস্তুসংস্থান এর উপর ভবিষ্যৎ প্রভাব নিয়ে বিচলিত হয়ে পড়েছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। নদীটির বুক চিরে প্রতি বছর বয়ে যাবে ৬ বিলিয়ন ঘন মিটার (২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট) পানি।
শোনতে চমৎকার শোনালেও এই প্রবাহের সাথে সাথে বদলে যাবে তীরবর্তী এলাকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। অনেকগুলো সম্ভাবনার মধ্যে একটি সমূহ আশংকা হলো নিবিড় কৃষির মাত্রা বেড়ে যাবে, ফলে ঐ এলাকার বাস্তুসংস্থান ও জীববৈচিত্র্য একটি বড়সড়ই ধাক্কা খাবে বলা চলে। শুধু তাই না, এর কারণে সংশ্লিষ্ট নদীর মাধ্যমে প্রবাহিত পানির পরিমাণ কমে যাবে, ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হবে ভারত ও বাংলাদেশ। ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন এমনকি ভূমিকম্পের আশংকাও করছেন বিজ্ঞানীরা।
তিব্বতের বৃষ্টি
সম্প্রতি চীন দেশটিতে বৃষ্টিপাত বাড়ানোর জন্য তিব্বতের মালভূমির পাশেই একটি রকেট ভিত্তিক যন্ত্রের ব্যাটারি স্থাপন করেছে। যন্ত্রটি থেকে সিলভার আয়োডাইড নিঃসরণ হবে যা থেকে মেঘ উৎপাদন হবে এবং ৬ লাখ বর্গ মাইল জুড়ে বৃষ্টিপাত হবে। মূলত মালভূমির আশপাশের এলাকায় পানির অভাব দূর করতেই এ পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
তবে এ পরিকল্পনা সত্যিই বাস্তবায়িত হলে সেখানকার জলবায়ুর নাটকীয় পরিবর্তন হবে, খুব সম্ভবত সেখানকার এলপাইন ও তৃণভূমি ভিত্তিক বাস্তুসংস্থান হুমকির মুখে পড়বে। যেসকল জীববৈচিত্র্য শুধুমাত্র ঐ এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল, সেগুলোর বিলুপ্তি ঘটতে পারে। বিজ্ঞানীরা আশংকা করছেন এ ধরনের কাজের ফলে তিব্বত থেকে নেমে আসা নদীর গতিপ্রকৃতি ও প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে। আর তাহলে নদীর গতিপথ সংশ্লিষ্ট পুরো এশিয়ার বাস্তুসংস্থানই ক্ষতিগ্রস্থ হবে। টাইগার পিউরিটান নিয়ে পড়তে পারেন।
লবণাক্ততা সহিষ্ণু ধান
লবণাক্ততা সহিষ্ণু ধানের জাত আবিষ্কার নিঃসন্দেহে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি অন্যতম মাইলফলক। কারণ সম্প্রতি সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকাসমূহে সেচের পানি ও চাষযোগ্য জমিগুলোতে লবণাক্ততা বাড়ছে। ফলে প্রচলিত ধানের জাতগুলো আর চাষ করা সম্ভব হচ্ছে না।
কিন্তু যদি উপকূলবর্তী এলাকায় ও লবণাক্ত জমিতে এই ধান নিয়মিতভাবে চাষ করে যাওয়া হয়, তাহলে ঐ এলাকাসমূহের জীববৈচিত্র্য নিয়ে আবার ভাবতে হবে। উপরন্তু সেচের উদ্দেশ্যে লবণাক্ত পানিকে প্রশমন করার জন্য অবশ্যই মিঠা পানির উৎস থাকতে হবে। সেটাও আরেক ঝক্কির ব্যাপার হবে।
জিন এডিটিং এর উন্মুক্ত প্রান্তর
ক্রিসপিআর প্রযুক্তির মত জিন এডিটিং প্রযুক্তি এখন সারা বিশ্বের গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য সাদরে গ্রহণ করা হচ্ছে। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচার ও ভোটের মাধ্যমে তাদের সকল কাজে ক্রিসপিআর প্রযুক্তি সংক্রান্ত সকল কাজের বিধিনিষেধ তুলে নিয়েছে।
যদিও এটি এখনো অনিশ্চিত যে জিনোম এডিটিং করেই সকল সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। তবে জিনোম এডিটিং এর ফলে রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার কমানো, অল্প জমিতে অধিক চাষ ইত্যাদির ফলে জীববৈচিত্র্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত কোন ভুল এর উল্টোটাও ঘটাতে পারে।
সন্দেহ জাগানিয়া তেলবীজ শস্য
মাছের দেহে যে স্বাস্থ্যকর ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায়, বিজ্ঞানীরা তেলবীজ শস্যের মধ্যে সেটি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছেন। এটি একটি দারুণ সুখকর সংবাদ যে এর ফলে ভোজ্য তেলের পুষ্টিমান তো বাড়বেই, সেই সাথে সাগরে বা নদীতে যথেচ্ছভাবে মৎস্য শিকারও কমবে। তাহলে খারাপ সংবাদটা কি?
যদি একসময় সকল প্রচলিত তেলবীজ শস্যের বিপরীতে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে উদ্ভাবনকৃত শস্যের চাষই হয়, তাহলে খুব সম্ভবত পোকামাকড় যারা এইসব উদ্ভিদের ওপর জীবনধারণ করে থাকে, তারা বিপদে পড়বে। এক গবেষণায় দেখা গেছে যেসকল প্রজাপতির লার্ভা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারড তেলবীজ উদ্ভিদ খেয়েছে, সেগুলোর পরবর্তীতে আকার আকৃতিতে বিকলাঙ্গতা বিশেষ করে অস্বাভাবিক পাখা দেখা গেছে।
উদ্ভিদ- অণুজীব রসায়ন
টেকসই কৃষির জন্য উদ্ভিদের আশেপাশের অণুজীবের ভূমিকা অসামান্য। জটিল এই অণুজীব বৈচিত্র্যের পরিবর্তন পরিবর্ধন এর মাধ্যমে উদ্ভিদের বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ, খরা সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি এবং আরো অনেক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
প্রযুক্তির অপ্রতুলতার কারণে পূর্বে এগুলো করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু বর্তমানে ডিএনএ সিকোয়েন্সিং এর সহজলভ্যতা এবং যন্ত্রপাতির উন্নয়নের ফলে প্রচুর কৃষিবান্ধব অণুজীব চাষ, বিস্তৃতির উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে।
সায়েন্টিফিক আমেরিকান থেকে অনূদিত।
মূল আর্টিকেল লিংক- Surprising Changes Will Affect Biodiversity in 2019
- বিলুপ্তপ্রায় পিউরিটান টাইগার বিটলকে বাঁচানোর উদ্যোগ - February 1, 2019
- পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে ভাবাবে যে ১০ টি বিষয় - January 23, 2019
- উদ্ভিদের বালাই প্রতিরোধে সিলিকনের ব্যবহার - January 1, 2019