গুটিকলম দাবাকলমের মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি। গুটি কলম সাধারণত ফল গাছের গাছের বংশ বিস্তারে ব্যবহৃত হয়। দেশীয় বিভিন্নরকম ফলের বংশবিস্তারে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যেমনঃ পেয়ারা, লেবু, জামরুল, লিচু, ডালিম, করমচা, গোলাপজাম, জলপাই, কামিনী ইত্যাদি।
কলম করার জন্যে একটি সুস্থ ফলদ গাছের নীরোগ কুঁড়ি সমৃদ্ধ ডাল কাটা হয়, যাকে সায়ন বলি। আর যে মাতৃ উদ্ভিদে কলমের শাখা গজানোর জন্যে ডালটিকে পুষ্টি উপাদান দিয়ে যুক্ত করে রাখা হয়, তাকে রুটস্টক বলে।
সাধারণত ঝোপালো কম উঁচু ফল গাছে এ ধরণের গাছের বংশবিস্তারের জন্য গুটি কলম উপযোগী।
শাখা গুটি কলম
যেসব গাছের শাখার অগ্রভাগের অংশ নিচের দিকে নুইয়ে পড়ে সেশব গাছে শাখা কলম করা হয়। শাখা কলম করার জন্যে এর কিছু অংশবিশেষের বাকল তুলে ৫–৭ সেমি মাটির গভীরে পুঁতে রাখা হয়। দুই–তিন সপ্তাহের মধ্যে বাকল তোলা উপরের অংশের গোড়া থেকে অস্থানিক শিকড় গজায় এবং তখন মাতৃগাছ থেকে এটিকে বিচ্ছিন্ন করে রোপণ করা হয়। যেমনঃ রাস্পবেরী, কালো জাম ইত্যাদি।
আরও পড়ুনঃ লিচুর মাজরা পোকার প্রতিকার
গুটি কলমের ধাপসমূহ
ক) সুস্থ-সবল ও নীরোগ শাখা নির্বাচন।
খ) নির্বাচিত শাখার বাকল তুলে ফেলা।
গ) কাটা অংশে রুটিং মিডিয়ামের ব্যবহার।
ঘ) রুটিং মিডিয়ামসহ গাছকে পলিথিন দিয়ে পেচিয়ে আবদ্ধ রাখা।
ঙ) মূল উৎপাদন।
গুটি কলমের শাখা নির্বাচনে নির্দেশিকা
ক) ভূমির সমান্তরালে অবস্থান করা শাখা নির্বাচন।
খ) কচি ও সুস্থ শাখা নির্বাচন।
গ) ডালটির পুরুত্ব পেন্সিলের মত হতে হবে
ঘ) শাখা কলম করার স্থান দক্ষিণ-পূর্ব দিকে করা উত্তম।
রুটিং মিডিয়া প্রস্তুতি
কলম করার জন্যে রুটিং মিডিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। রুটিং মিডিয়া কলম কালীন অবস্থায় শাখাকে পুষ্টি সরবরাহ করে থাকে। কলম করার জন্যে যেসব রুটিং মিডিয়ামের প্রয়োজনঃ
ক) ৫০% এঁটেল-দোআঁশ মাটি
খ) ৫০% গোবর সার
গ) নারিকেলের ছোবড়া/ গুড়া
ঘ) পাটের আঁশ
এগুলো একসাথে মিশ্রিত করে শিকড় গজানোর স্থানে ঢেকে দিতে হবে।
কলম করার পদ্ধতি
কলম করার জন্যে নির্বাচিত শাখাটির অগ্রভাগ থেকে ৩০-৫০ সেমি নিচে দুটি পর্বের মধ্যবর্তী অংশ একটু জীবাণুমুক্ত ছুরি দিয়ে গোল করে বাকল তুলে ফেলতে হয়। কাটা অংশের সেলুলোজ অঞ্চলের সবুজাভ আবরণ ভালভাবে ছেঁচে ফেলতে হবে। এতে ক্যাম্বিয়াম্বের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। গিটের কাছাকাছি অংশে শিকড় তাড়াতাড়ি গজায়।
রুটিং মিডিয়াম দিয়ে এর চারিপাশে স্থাপনের পর পলিথিনের স্বচ্ছ ট্যাপ দিয়ে মজবুত করে বেধে দিতে হবে। রুটিং মিডিয়ামের পানি ধারণ ক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে।
কিছু প্রজাতির গাছে শিকড় গজাতে বাধাগ্রস্থ হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে রুটিং হরমোন ব্যবহার করা যেতে পারে। কলমের কাটা প্রান্তে রুটিং হরমোন (যেমন IBA, NAA, Kinetin ইত্যাদি) প্রয়োগ করা হয়। বৈশাখ – আষাঢ় মাস গুটি কলম করার উত্তম সময়।
গুটি কলম থেকে শিকড় গজাতে প্রজাতির প্রকারভেদে কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত সময় নেয়। শিকড় গজিয়ে খয়েরি রঙ ধারণ করলে ২ থেকে ৩ বার কেটে নিয়ে বীজতলায় রোপন করতে হয়।
আরও পড়ুনঃ ছাদবাগানে আম চাষ – আম গাছের জোড় কলম পদ্ধতি
লিচু গাছের গুটি কলম করার পদ্ধতি
লিচু গাছের কলম উপযুক্ত সময় বর্ষাকাল। গুটি কলমের জন্যে এক থেকে দুই চারা ব্যবহার করা উত্তম।
ক) নির্বাচিত কান্ডের আগা থেকে ৩০–৫০ সেন্টিমিটার পর গিঁটের নিচে কেটে ফেলতে হবে।
খ) কাটা প্রান্তে ৩–৪ সেন্টিমিটার পরিমাণ বাকল ধারালো জীবাণুওমুক্ত ছুরি দিয়ে গোল করে তুলে ফেলতে হবে।
গ) এরপর মাটির সাথে জৈব সার মিশ্রিত (৩ ভাগ এঁটেল মাটি ও ১ ভাগ পঁচা গোবর বা পাতা পঁচা ) করে পানি মিশিয়ে উপযুক্ত মিশ্রণ তৈরি করতে হবে। উক্ত মিশ্রণ দ্বারা কাটা অংশের চারিদিকে ঢেকে দিতে হবে৷
ঘ) ঢেকে দেয়ার পর ২০ সেমি লম্বা ও ৩ সেমি চওড়া পলিথিনের ট্যাপ দিয়ে জৈব সার-মাটি দিয়ে তৈরি বলটি ঢেকে দিয়ে সূতা দিয়ে বেঁধে দিতে হবে ৷
ঙ) শিকড় গজাতে সময় নেয় ২–৩ মাস ৷ শিকড়ের রঙ খয়েরী বা তামাটে হলে কলম করা ডালটি গুটিসহ কেটে এনে ছায়াময় স্থানে তৈরি বীজতলায় বা নার্সারী বেডে ৪–৫ সপ্তাহ সংরক্ষণ করার পর গাছটি লাগানোর উপযোগী হয়৷
গুটি কলম এর ছবি দেখুন
গুটি কলমের সুবিধা
ক) এটি অন্যান্য কলম প্রক্রিয়ার চেয়ে তূলনামূলক সহজ পদ্ধতি এবং খুব একটা দক্ষতার প্রয়োজন নেই।
খ) অল্প সময়ে বহু সংখ্যক গাছের চারা উৎপাদন করা যায়।
গ) কলম করা চারায় বীজ পদ্ধতির চেয়ে স্বল্প সময়ে ফল ধারণ করে।
ঘ) যে সমস্ত প্রজাতি কাটিং এ সহজে শিকড় গজায় না তাদের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ব্যবহার উপযোগী।
ঙ) কলম করা চারা পোকামাকড় ও মাটিবাহিত রোগ সহনশীল হয়ে থাকে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সুবিধা। কলম করা চারাটি ব্যাক্টেরিয়া, ফাঙ্গাস, নেমাটোড, নডিউল, টোবাক্যো মোজাইক ভাইরাস ইত্যাদি সহনশীল ক্ষমতা সম্পন্ন হয়ে থাকে।
চ) নতুন চারাটির মাতৃ উদ্ভিদের চেয়ে বেশি জীনগত উন্নয়ন সাধিত হয়ে থাকে।
ছ) নতুন চারাটি লবণাক্ততা, আর্দ্রতা সহনশীল হয়ে থাকে।
গুটি কলমের অসুবিধা
ক) বাণিজ্যিকভাবে এ পদ্ধতি কাটিং অপেক্ষা ব্যয়বহুল।
খ) এই পদ্ধতিতে বংশবিস্তার করতে গেলে অধিকসংখ্যক মাতৃ উদ্ভিদের প্রয়োজন হয়।
গ) সঠিক পদ্ধরি অনুসরণ না করলে চারাটি আশানুরূপ হয় না।
সুবিধা অসুবিধা বিবেচনায় এনে যদি এই পদ্ধতিতে বংশবিস্তার করে যদি একজন বাগানী একে লাভজনক মনে করেন তবে তখনই এটিকে গ্রহণ করাই বাঞ্ছনীয়।
- বাংলাদেশে পঙ্গপাল আক্রমণের সম্ভাবনা - July 10, 2020
- রকমেলন চাষ ও এর পরিচর্যা - July 6, 2020
- ঘরোয়া উদ্ভিদের রোগ-বালাই নিয়ন্ত্রণ – দ্বিতীয় পর্ব - July 3, 2020
লিচুর গুটি কলম করার সময় পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেয়ার পর কি নিয়মিত পানি দিতে হয়?