লাউয়ের নাম শুনলেই যে গানটি প্রথমেই মনে পড়ে সেটি হল – “স্বাদের লাউ, বানাইলো মোরে বৈরাগী”। এছাড়াও খুবই সুপরিচিতি একটি বাগধারা, যেটা আমরা কথায় কথায় প্রায়শই ব্যবহার করে ফেলি, “যেই লাউ, সেই কদু”। লাউ আর কদু যে নামেই বলি না কেনো এটি বাংলাদেশের জনপ্রিয়তম একটি সবজি। দুটি কারণ বল যেতে পারে এক্ষেত্রে। প্রথমত, লাউ সারা বছরই চাষ করা যায়। দ্বিতীয়ত, লাউ দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। এছাড়া শুধু ফলই আমাদের পুষ্টি যোগায় না, লাউয়ের শাকও খুবই সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। আবহামান বাঙালী মায়েরা লাউয়ের তরকারি ও সবজি ভাজি করতে বেশ পছন্দ করে থাকেন। লাউ আমাদের খাদ্যের সাথে সাথে সংস্কৃতিতেও জড়িয়ে গেছে।
এতো ভালোবাসা যেই লাউকে কেন্দ্র করে, সেই লাউয়ের আদি উৎপত্তিস্থল কিন্তু উপমহাদেশ নয়। আমেরিকার নিরক্ষীয় ও উপ-নিরক্ষীয় অঞ্চলে লাউউয়ের উৎপত্তিস্থান। মার্কিনমুলুকের দক্ষিণ থেকে সরু পেরু শেষ মাথা পর্যন্ত এই এলাকা বিস্তৃত। এই সব এলাকায় লাউয়ের চাষ আনুমানিক দশ হাজার বছরেরও পুরনো। কি অদ্ভূত, তাই না? তবে বর্তমানে প্রায় সব দেশের প্রধাণত গ্রীষ্মপ্রধান দেশে লাউয়ের চাষ বিস্তৃতি লাভ করেছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লাউ বিভিন্ন নামে পরিচিত। এর মধ্যে কিছু জনপ্রিয় নাম হল মিষ্টিকুমড়া, মিষ্টি লাউ, মিষ্টি কদু, আউষী কদু, মাটি কদু, কুমোড় ইত্যাদি। লাউ কিন্তু মিষ্টি কোনো সবজি নয়। যদিও এটি মিষ্টি সবজি নামে গ্রামাঞ্চলে পরিচিত। ইংরেজিতে লাউকে Pumpkin, Squash শব্দে ডাকা হয়।
বৈচিত্র্যময় লাউ মূলত দুইরকমের হয়ে থাকে। যথা- ঝোপালো ও লতানো। লাউয়ের শিকড় মাটিতে বাধাগ্রস্থ না হলে যথেষ্ট গভীর পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে ১.৮৩ মিটার পর্যন্ত প্রবেশে সক্ষম। যদিও অধিকাংশ জাতই ৮ সেন্টিমিটারেই অবস্থান করে। তাই অনায়াসেই আপনার ছাদবাগানে মাচা করে লাউয়ের চাষ করতে পারবেন।
লাউয়ের পাতা সরল, ফাঁপা বোঁটাধারী এবং লোমাবৃত থাকে। কিছু প্রজাতির লাউয়ের পাতা কিছুটা ত্রিভুজাকৃতি, ফলকের কিণারা ৩-৭ খন্ডে বিভক্ত। ফলক ও বোঁটা কাটার মতো লোমে আবৃত থাকে।
লাউয়ের ফল জাত অনুযায়ী ১০০ গ্রাম থেকে ১৫০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে! কি অবাক হলেন? না ভুল শুনেননি। কিছু কিছু জাতের লাউ কিন্তু ১৫০(!) কেজি পর্যন্তও হয়ে থাকে
জাত
বাংলাদেশের লাউয়ের সব জাতই C. moscheta প্রজাতিভুক্ত। এই জাতের সংখ্যা খুব একটা বেশিও নয়। এদের জীনগত ভ্যারিয়েশনও তুলনামূলক কম। বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের অনুমোদিত বারি লাউ – ১ চাষ করা যেতে পারে।
জলবায়ু
লাউয়ের শুষ্ক ও উষ্ণপ্রধান জলবায়ু প্রয়োজন। উচ্চ ফলনের জন্যে চারমাসব্যাপী ১৫-৩০°সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা ও প্রচুর সূর্যের আলোর উপস্থিতি প্রয়োজন। বাংলাদেশের বেশিরভাগ লাউই শীতপ্রধান জাতের। খুব অল্প পরিমাণ জাত গরমকালেও চাষ করা হয়
জমি তৈরি ও বীজ বপন
বাংলাদেশের আবহাওয়ায় বছরের যেকোনো সময়ই লাউয়ের বীজ লাগানো যায়। তবে শীতকালীন ফসলের জন্যে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি ও খরিফ মৌসুমের ফসলের জন্যে ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত সময়ে লাগিয়ে থাকে।
অল্প পরিমাণে লাউ চাষ করতে বাড়ির আশেপাশে ছায়াহীন স্থানে মাদা করে বীজ বোনা যেতে পারে। ছাদবাগানে করতে গেলে চিলেকোঠার কাছাকাছি করা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রেও মাদা তৈরি করতে হবে। ঝোপালো জাতের বেলায় পাশাপাশি দুটি মাদার মধ্যে দুই মিটার দূরত্ব রেখে বীজ বুনতে হবে। লতানো জাতের ক্ষেত্রে ৩-৪ মিটার হতে হবে। আরও পড়ুন ড্রাগন ফল নিয়ে।
সার প্রয়োগ
প্রতি গর্তে জমি তৈরির সময় নির্ধিষ্ট পরিমাণে সার প্রয়োগ করতে হয়
পচা গোবর ১০ কেজি
টিএসপি ৪০০ গ্রাম
এমওপি ৩০০ গ্রম
বোরণ ২ গ্রাম
ইউরিয়া ৫০০ গ্রাম
ইউরিয়ার ১/৫ অংশ ও সমুদয় সার দিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে। ইউরিয়ার বাকি ৪ অংশ চার কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
সেচ ও নিষ্কাশন
শুষ্ক মৌসুমে লাউয়ের চাষ করলে সেচে প্রয়োজন হয়। ১৫ দিন পর পর ২-৩ বার করে সেচ দিতে হবে। বর্ষাকালে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পরিচর্যা
বাউনীর উপরে কান্ড তুলে দিলে ফুলের গুণ ভাল হয় ও ফলন বেশি হয়। কিন্তু বাউনীর খরচ যোগ হওয়ায় এতে অর্থনৈতিক দিক খেয়াল রাখতে হয়। লতানো জাতের গাছ চাষ করলে ফল ধরার সময় ফলের নিচে কিছু খড়কুটো বিছিয়ে দেওয়া ভাল যেন মাটির সংস্পর্শে রোগাক্রান্ত না হয়ে পড়ে।
পরাগায়ণ
কৃত্রিম পরাগায়ণের মাধ্যমে ফলের সংখ্যা ও ফলন বৃদ্ধি করা যায়। আশেপাশে যথেষ্ট মৌমাছি ও অন্যান্য পরাগায়নকারী পোকামাকড়ের আনাগোনা থাকলে সাধারণত কৃত্রিম পরাগায়ণের প্রয়োজন হয় না। কৃত্রিম পরাগায়ণের জন্যে ভোরবেলা পুরুষ ফলের পরাগধানী হাতে নিয়ে স্ত্রী ফুলের গর্ভমুন্ডে আস্তে করে ঘষে দিতে হয়। আরও পড়ুন চালকুমড়ার স্বাস্থ্যগুণ ও চাষপদ্ধতি।
পোকামাকড় ও রোগবালাই প্রতিকার
মাছি ও জাবপোকা
এ পোকা লাউয়ের কচি ডগা বা গাছের পাতার রস শুষে খেয়ে ফেলে। এতে গাছ দুর্বল হয়ে যায়। ফলে গাছের বৃদ্ধি কমে ফলন হ্রাস পায়। মাছি পোকা লাউয়ের খোসার নিচে দিকে ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার কয়েকদিনের মধ্যেই লার্ভা বা কোড়া বের হয়ে আসে এবং লাউয়ের কচি অংশ খাওয়া শুরু করে।
পাউডারি বা ডাউনি মিলিডিউ
এ রোগে আক্রমণের ফলে গাছের পাতায় পাউডারের মতো আবরণ দেখতে পাওয়া যায়। মাটিতে রস থাকলে এ রোগ হয়। পানি নিষ্কাশনের ঘাটতির ফলে এই রোগের আক্রমণ বেড়ে যায়। ডাউনি মিলিডিউ রোগে গাছের পাতার রঙ বাদামি হয়ে যায় ও পাতা কুঁচকে যায়।
প্রতিকার
থিওভিট বা সালফার জাতীয় যেকোনো ছত্রাকনাশকের ব্যবহার (০.২%) করতে হবে।
লাউয়ের মাছিপোকা
পূর্ণবয়স্ক মাছিপোকা বাদামি বর্ণের গাঢ় হলুদ দাগযুক্ত হয়ে থাকে। স্ত্রী মাছি কচি ফলের গায়ে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে পোকার ফলের ভেতর ঢুকে পড়ে এবং লাউয়ের কচি অংশ খেয়ে নষ্ট করে। ফলে আক্রান্ত লাউ পচে যায় এবং অকালে ঝরে যায়।
প্রতিকার
বিষটোপ তৈরি করে এর আক্রমণ রোধ করা যায়। কীটনাশক ব্যবহার করে এ পোকা দমন করতে হলে গাছে কচি ফল দেখা দেয়ার সাথে সাথে প্রতি লিটার পানিতে ডিপটেরক্স-৮০ এসপি ১.০ গ্রাম অথবা ডিপটেরক্স-৫০ ইসি ১.৫ মিলিলিটার মিশিয়ে ১৫ দিন অন্তর গাছে স্প্রে করতে হবে।
ফসল সংগ্রহ
স্থানীয় জাতের লাউ কাঁচা ও পাকা উভয় অবস্থায়ই খাওয়া যায়। যদিও কাঁচা ফল অল্প মিষ্টি বা মিষ্টতাহীন হয়ে থাকে। পরিক্কতা লাভের জন্যে ফল গাছে রেখে দিলে অধিক সংখ্যায় ফল উতপাদন বাধাগ্রস্থ হয়। তাই খাওয়ার উপযোগী হওয়া মাত্রই ফল পেড়ে ফেলা উচিত। সংরক্ষণ করতে হলে সম্পূর্ণ পাকার পর ফল সংগ্রহ করতে হবে। পাকার সাথে সাথে ফল হলুদ বা কমলা রঙ ধারণ করে।
- বাংলাদেশে পঙ্গপাল আক্রমণের সম্ভাবনা - July 10, 2020
- রকমেলন চাষ ও এর পরিচর্যা - July 6, 2020
- ঘরোয়া উদ্ভিদের রোগ-বালাই নিয়ন্ত্রণ – দ্বিতীয় পর্ব - July 3, 2020