সৌখিন বাগানীদের নিকট ঘরোয়া উদ্ভিদের কদর আলাদা। দারুণ দারুণ নকশা করা পট, টেরাকোটায় দেশি-বিদেশী নানানরকম সুলভ ও দূর্লভ ঘরোয়া উদ্ভিদ বাড়িতে রাখা এখন আভিজাত্যের প্রতীক, সাথে সাথে দারুণ স্বাস্থ্যকর অভ্যাস। প্রিয় ঘরোয়া উদ্ভিদ রোগ-বালাইয়ে আক্রান্ত হলে চিন্তার বলিরেখা পড়ে সৌখিন বাগানীদের কপালে। নানারকম জৈব, অজৈব, কীটনাশক ব্যবহার করে আপ্রাণ চেষ্টা করেন প্রিয় ঘরোয়া উদ্ভিদটিকে বাঁচাতে। আমরা পর্ব আকারে জানাচ্ছি কিভাবে ঘরোয়া উদ্ভিদের রোগ-বালাই খুব সহজেই দমন করা সম্ভব। এই পর্বে আমরা রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ ও কিছু প্রধান কীটপতঙ্গ পরিচিতি ও এদের দমনব্যবস্থা জানব।
প্রথম পর্ব পড়ুনঃ ঘরোয়া উদ্ভিদের রোগ-বালাই নিয়ন্ত্রণ – প্রথম পর্ব
রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ
যদি জৈব নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিগুলিও ব্যর্থ হয় এবং ঘরোয়া উদ্ভিদটি বেশ দামী ও আপনার অনেক পছন্দের হয়ে থাকে, তবে ভালমানের কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। সাধারণভাবে, একটি কীটনাশক সবরকমের কীটপতঙ্গকে মারতে পারে না। কিছু কীটনাশক নির্দিষ্ট কীট বা নির্দিষ্ট পোকামাকড়ের নির্দিষ্ট জীবনের পর্যায়ে কেবল কার্যকর। এছাড়া, এটিও বুঝতে হবে যে, কীটনাশকের একাধিক প্রয়োগ প্রায়শই নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন। ঘরোয়া উদ্ভিদগুলো্র কীটনাশক স্প্রে যেকোনো ভাল নার্সারিতেই পাবেন। কীটনাশক ব্যবহারের আগে, লেবেল পরে নিন। সাধারণত কীটনাশক প্রয়োগ ঘরের বাইরে নির্জনে করাই শ্রেয় এবং কীটনাশক পুরোপুরি শুকিয়ে যাওয়ার পরেি এটিকে ঘরের ভিতরে আনবেন।
সাধারণত, কীটনাশকের লেবেলে সুপারিশ করা হয় কোন কোন পোকামাকড় ও উদ্ভিদের জন্যে এটি উপযুক্ত। পাশাপাশি কীটনাশকের সংবেদনশীল উদ্ভিদ ও কীটপতঙ্গেরও একটি তালিকা অন্তর্ভুক্ত থাকে। গাছগুলিতে কীটনাশকে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে পাতা এবং কান্ডের বিকৃতি, পাতা হলুদ হয়ে যাওয়া, পাতা বা ফুল ফোটানো এবং পাতার কিনারা ধূসর হওয়া। ক্ষতিগ্রস্থ অংশটি প্রয়োগের ৫ থেকে ১০ দিনের মধ্যে দৃশ্যমান হয়, কখনওবা আরও দ্রুত দেখা দিতে পারে।
প্রধান কীটপতঙ্গ জনিত রোগ
অ্যাফিড
অ্যাফিড, দেখতে নাশপাতির মতো পোকা, আকৃতিতে বেশ ছোট, নরম-সাকার বিশিষ্ট হয়। এদের গায়ের রঙ সাধারণত সবুজ হয়ে থাকে তবে ক্ষেত্রে বিশেষে গোলাপি, বাদামী, কালো বা হলুদও হতে পারে। কিছু অ্যাফিড একটি মোমের আবরণের কারণে পশম বা পাউডারী হয়ে থাকে। বড় কীতের ডানা থাকতে পারে বা নাও থাকতে পারে।
এফিড সাধারণত কচি বর্ধণশীল পাতা বা পাতার পাতা নিম্নাংশে পাওয়া যায়। কিছু কিছু প্রজাতি শিকড় খেয়ে বেঁচে থাকে। এরা উদ্ভিদের রস শোষণ করে, ফলস্বরূপ পাতা হলুদ হয়ে বিকৃত হয়ে যায়। এছাড়াও, বৃদ্ধি থেমে যেতে পারে, এবং বর্ধণশীল কুঁড়ি বিকৃত হতে পারে। এফিড উদ্ভিদের রস শোষণ করার সাথে সাথে তারা “হানিডিউ” নামে একটি চিনিযুক্ত উপাদান বের করে যা পাতাকে চকচকে এবং আঠালো করে তোলে। শ্যুটি মোল্ড এই নিষ্কাশিত হানিডিউইয়ের সংস্পর্শে এসে বেড়ে উঠে এবং উদ্ভিদের পৃষ্ঠে কালো স্পটের সৃষিটি করে থাকে।
রোগ দমন
অল্প সংক্রমণে হাত দিয়ে তুলে ফেলা, পানি স্প্রে করা বা কটন বাড এলকোহল বা স্পিরিটে চুবিয়ে ঘষে ঘষে এফিড নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। কীটনাশক জাতীয় সাবান-পানি স্প্রেও ব্যবহার করা যেতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ট্রিটিমেন্ট পুনরাবৃত্তি করতে হবে। ঘরের বাইরে যেসব উদ্ভিদগুলো রাখা হয় এসব উদ্ভিদ থেকে এফিড নিয়ন্ত্রণের জন্য কীটনাশক সাবান, নিম তেল, পাইরেথ্রিনস (pyrethrins), এসিটামিপ্রিড(acetamiprid), ইমিডাক্লোপ্রিড(imidacloprid), সাইফ্লুথ্রিন(cyfluthrin) বা পেরমেথ্রিন(permethrin) দিয়ে স্প্রে করুন। আক্রমণ বেশি হলে ইমিডাক্লোরোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক (যেমন এডমায়ার অথবা টিডো ৭-১০ মিলিলিটার) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
মিলিবাগ
মিলিবাগ বেশ ছোট ও ফ্যাকাশে কীট। এরা বেশ ধীরে ধীরে চলাচল করে। প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী কীট ডিম ও নিজেদেরকে একটি সাদা, মোমের উপাদান দিয়ে ঢেকে রাখে। তখন এদের তুলোর মত দেখায়। কারও কারও মধ্যে মোমের মত ফিলামেন্ট থাকে যা তারা দেহের বাইরে ছড়িয়ে দেয়।
ডিম থেকে ফুটে (অপরিণত) এরা নিম্ফ অবস্থায় উপনীত হয়। এরা খাদ্য গ্রহণ শুরু করার পর এদের দেহে মোমের মত আবরণ গঠন শুরু হয়। মিলিবাগের শরীরাবরণে থাকা মোম কীটনাশককে প্রতিহত করতে সহায়তা করে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণে কিছুটা কঠিন করে তোলে। মিলিবাগকে সাধারণত পাতার নীচের পৃষ্ঠে এবং পাতার অক্ষতে দেখা যায় (যে অংশে পাতাটি কাণ্ডের সাথে সংযুক্ত থাকে)। এফিডের মতোই কিছু কিছু প্রজাতি শিকড়ও খেয়ে থাকে। তারা উদ্ভিদের রস শোষণ করে, বৃদ্ধি থামিয়ে দেয় ও আকার বিকৃত হতে থাকে এবং কখনও কখনও অধিক আক্রমণের গাছের মৃত্যুও ঘটতে পারে। এফিডের মতোই মিলিবাগও হানিডিউ ছড়ায়, যা কিনা শ্যুটি মোল্ড বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
রোগ দমন
অল্প সংক্রমণ ঘটলে এফিড নিয়ন্ত্রণের মতোই হ্যান্ড পিকিং কিংবা এলকোহল বা স্পিরিটে কাপড় চুবিয়ে ঘষে ঘষে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এছাড়া ডিটারজেন্ট পানিতে মিশিয়ে স্প্রে বোতলে নিয়ে সপ্তাহে ৩-৪ বার স্প্রে করা যেতে পারে। মারাত্মক সংক্রমণ ঘটলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে গাছ ফেলেও দিতে হতে পারে। আক্রমণ বেশি হলে ইমিডাক্লোরোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক (যেমন এডমায়ার অথবা টিডো ৭-১০ মিলিলিটার) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। এছাড়া অর্ধ ভাঙ্গা নিমবীজের পানি (হাফ লিটার পানিতে ২৫ গ্রাম নিমবীজ ভেঙ্গে ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে ছেঁকে পানি আলাদা করতে হবে) আক্রান্ত উদ্ভিদে ১০ দিন পর পর ৩ বার স্প্রে করলে মিলিবাগ নিয়ন্ত্রন হয়ে যায়। এছাড়াও তামাকপাতার গুড়া (১০ গ্রাম), সাবানের গুঁড়া (৫গ্রাম) ও নিম পাতার রস প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ব্যবহার করা যায়।
স্পাইডার মাইট
মাইট কোনো পোকামাকড় নয় তবে মাকড়সার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। যেহেতু এগুলি অত্যন্ত ছোট, উদ্ভিদে ক্ষতের চিহ্ন সাধারণত এদের উপস্থিতির প্রথম লক্ষণ। গাছে্র ক্ষতিগ্রস্থ অংশটি রেশমের জালসহ এদের উপস্থিতি প্রথম লক্ষ করা যায়।
প্রাপ্তবয়স্ক এবং অপরিণত স্পাইডার মাইট উভয়ই উদ্ভিদের রস শোষণ করে গাছের ক্ষতি করে। ক্ষতির মধ্যে পাতার উপরের পৃষ্ঠের হালকা রঙের ফুটকি পরিলক্ষিত হয়ে থাকে এবং উদ্ভিদ সামগ্রিক্ভাবে বিবর্ণ হয়ে যেতে থাকে। স্পাইডাত মাইটের অল্প আক্রমণেও উদ্ভিদের বিকাশের উপর একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। দীর্ঘদিন আক্রমণের ফলে আলোক সংশ্লেষণ এবং উদ্ভিদের স্ব-নিরাময়ের ক্ষমতা হ্রাস পায়। সাধারণ মাকড়সা মাইট শুষ্ক গ্রীষ্মে গাছকে অধিক হারে সংক্রমণ ঘটায়। এটি সাদা, হলুদ বা লাল বাদামীও হতে পারে। এর ডিম উদ্ভিদের পাতার ফলকে পাওয়া যাবে। কখনও কখনও পাতা ছাড়া শিকড়কেও ক্ষতি করতে পারে। ফলস্বরূপ উদ্ভিদের ফল ও বীজের গুণমানের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। মাইটগুলি যদি চেক না করা থাকে তবে পাতা হলুদ হয়ে যেতে থাকে এবং ধীরে ধীরে গাছটি মারা যেতে পারে।
রোগ দমন
মাকড়সার জঞ্জাল ধ্বংস করতে গাছে জোরে জোরে পানি স্প্রে করুন। পাতার নিচে ভালভাবে স্প্রে করবেন। উদ্ভিদগুলিকে ডিটারজেন্ট পানি স্প্রে করা যায়। বাড়ির বাইরে থাকা বাড়ির উদ্ভিদের জন্য, কীটনাশক সাবান, নিম তেল নিষ্কাশন বা সালফারযুক্ত কীটনাশক স্প্রে করুন। মাইটগুলি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বেশিরভাগ সপ্তাহে একবার করে হলেও স্প্রে করা প্রয়োজন।
গ্রীষ্মকালে বাড়ির বাইরে রাখা উদ্ভিদে মাকড়সা মাইটের সমস্যা কম দেখা দেয়। প্রাথমিকভাবে ঘরের সমস্ত উদ্ভিদগুলি ছাদে ছায়ায় রেখে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করুন, নইলে গাছগুলো হঠাত রোদের সংস্পর্শে এসে ঝলসে যতে পারে।
- বাংলাদেশে পঙ্গপাল আক্রমণের সম্ভাবনা - July 10, 2020
- রকমেলন চাষ ও এর পরিচর্যা - July 6, 2020
- ঘরোয়া উদ্ভিদের রোগ-বালাই নিয়ন্ত্রণ – দ্বিতীয় পর্ব - July 3, 2020