আম আমাদের সবার খুবই প্রিয় একটা ফল। ছোট বড় সবাই কম বেশি আম খেতে ভালবাসে। কিন্তু আমি মাঝেমাঝে চিন্তা করি যে আম যদি না কিনে সহজে উৎপাদন করা যেতো তাহলে খুব ভাল হত! আমি জানি আমার মতন আপনারাও একি রকম চিন্তা ভাবন করেন। আজকে আমি তাই আম গাছের জোড় কলম পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। আম গাছের জোড় কলম পদ্ধতি ছাড়াও আর একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি আলোচনা করব, সাহায্য আপনি আপনার ছাদবাগানে খুব সহজে আম উৎপাদন করতে পারবেন।
জোড় কলম বা গ্রাফটিং কি?
জোড় কলম হল একটি পদ্ধতি যেখানে একটি আম গাছ থেকে সায়ন সংগ্রহ করে আম গাছের রুটস্টক এর কাণ্ডে জোড়া লাগিয়ে দেয়া হয়। পরবর্তীতে যা গাছের স্থায়ি অংশ হয়ে যাবে। সায়ন এর বৈশিষ্ট্যর উপর নির্ভর নতুন গাছ এর বৈশিষ্ট্য তৈরি হয়।
জোড় কলম তৈরি করার উপযুক্ত সময়?
আমের জোড় কলম তৈরি করার উপযুক্ত সময় হল বসন্ত কাল। কারন এই সময়ে আমের মুকুলগুলো খুলতে শুরু করে যতক্ষণ পর্যন্ত ফুল না ফুটতে শুরু করে। এপ্রিল থেকে আগষ্ট মাস পর্যন্ত সময়টা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত সময়।এসময় গাছের কান্ড শাখা প্রশাখা দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
আমের জোড় কলম তৈরি করার উপকরণ
· ধারালো চাকু বা ছুরি,
· পলিথিন ফিতা,
· পলিথিন ক্যাপ,
· সুতুলি,
· একটি এক থেকে দেড় বছরের আমের স্টক চারা ,উন্নত জাতের আমের ডগা বা সায়ন।
আমের জোড় কলম তৈরি করার পদ্ধতি
জোড় কলম সাধারণত দুই পদ্ধতিতে হয়ে থাকে যেমন :
সংযুক্ত জোড় কলম
এই পদ্ধতিতে যে সায়ন টি নির্বাচন করা হয় সেটি মাতৃগাছ হতে না কেটে রুটস্টকের সাথে জোড়া লাগাতে হবে।
বিযুক্ত জোড় কলম
এই পদ্ধতিতে যে সায়ন টি নির্বাচন করা হয় তা মাতৃগাছ হতে কেটে এনে রুটস্টকের সাথে জোড়া লাগানো হয়।
আরও পড়ুনঃ বিভিন্ন ধরণের মাটি চিনুন
সংযুক্ত জোড় কলম
সংযুক্ত জোড় কলমের মধ্যে কয়েকটা পদ্ধতি আছে তার মদ্ধে সংস্পর্শ জোড় (Contact grafting) কলমই প্রচলিত বেশি। এটি সবচেয়ে পুরাতন পদ্ধতি। সংযুক্ত জোড় কলমের পদ্ধতিগুলো হলো:
· সংস্পর্শ জোড় কলম (Contact grafting)
· ভিনিয়ার গ্রাফটিং (Veneer grafting)
সংস্পর্শ জোড় কলম (Contact grafting) এর ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় গুলোঃ
রুটস্টক নির্বাচন
- সাধারণত ১ বৎসর বয়সের চারা নিতে হবে। তবে রুটস্টকের ব্যাস সায়নের ব্যাসের সমান হতে হবে।
- রুটস্টক অবশ্যই পলিব্যাগ অথবা মাটির পাত্রে রাখুন।
- রোগ বালাইমুক্ত ও সতেজ রুটস্টক নির্বাচন করুন।
সায়ন নির্বাচন
যে মাতৃ গাছটি বাছাই করেছেন তার সুস্থ, সবল ও চলতি মৌসুমের ডাল নির্বাচন করুন। সায়ন এর ব্যাস রুটস্টকের ব্যাসের সমান হওয়া ভাল।
সময়ঃ গ্রীষ্ম-বর্ষাকাল (বৈশাখ-আষাঢ়)
প্রস্তুত পদ্ধতি
· প্রথমেই স্টক চারাটির নিচের দুই সারির পাতা রেখে উপরের ডগাটি ছুরি দিয়ে কেটে ফেলে দিতে হবে।
· ছুরি দিয়ে কাটা অংশ থেকে নিচ দিকে লম্বা লম্বি ভাবে এক থেকে দেড় ইন্চি পরিমান ফেরে নিন বা ফাটল সৃষ্টি করুন।
· এখন যে সায়নটি আপনি নিয়েছেন তার ব্যাশ অবশ্যই স্টক চারাটির ব্যাশের সমান আকার হবে এব তার বয়স সর্বনিন্ম ১মাস হতে হবে ।
· এবার সায়নটির দুই পাশে আড়াআড়ি ভাবে কেটে চোখা বা গোজ আকৃতির করুন।
· স্টক চারার ফাটলে সায়নটি এমনভাবে প্রতিস্থাপন করতে হবে যেন সায়ন এবং স্টক চারার বাকল একসাথে মিশে থাকে সায়ন এবং স্টক চারা অসম আকারের হলে যেকোন এক পাশের বাকলের সাথে অবশ্যই মিশিয়ে স্থাপন করতে হবে।
· পলিথিন ফিতা দিয়ে জোরা দেয়া অংশটি নিচ থেকে পেচিয়ে উপরে বেধে দিতে হবে পলিথিন ফিতা দিয়ে পেচিয়ে বেধে দেয়ার পর পলিথিন ক্যাপ দিয়ে এমন ভাবে ঢেকে বেধে দিতে হবে যেন জোরা দেয়া অংশে কোন ভাবেই বাতাস ঢুকতে না পারে।
· সবশেষে, জোরাটি সফল হলে ৪০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যেই সায়নের ডগায় নতুন পাতা বিকশিত হবে।
· নতুন পাতা বিকশিত হলে পলিথিন ক্যাপটি খুলে দিতে হবে এবং ৩ মাস পর পলিথিন ফিতাটি খুলতে হবে ।
· এর আগে খোলা হলে চারাটি নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকতে পারে।
সতর্কতা
Ø রুটস্টকে নতুন কুশি বের হয় তাই তখন নতুন কুশি ভেঙ্গে দিতে হবে।
Ø রুটস্টকের যেখানে রাখবেন তাতে সবসময় ভেজা বা রস থাকতে হবে।
Ø রুটস্টক বা সায়ন জোড়া লাগলে মাতৃগাছ হতে ধারালো ছুরি দিয়ে ১-৩ বারে কেটে নামিয়ে আনতে হবে।
Ø কলমটিকে কিছুদিন আলো থেকে দূরে ছায়াতে রেখে দিতে হবে।
Ø ২-৩ মাস পর রুটস্টকের উপরেরদিকের অংশ কেটে দিতে হবে।
ভিনিয়ার গ্রাফটিং (Veneer grafting)
ভিনিয়ার পদ্ধতি বর্তমানে অনেক প্রচলিত একটি পদ্ধতি। প্রায় শতকরা ৮০ ভাগই আমের কলম ভিনিয়ার পদ্ধতিতে করা হয়। এটি খুবি জনপ্রিয় আক্তা পদ্ধতি কারন এতে আম চাষ এর সফলতা বেশি।
ভিনিয়ার পদ্ধতিতে কাঙ্ক্ষিত জাতের গাছ থেকে সায়ন কেটে নিয়ে এসে রুটস্টকের সাথে বিশেষ পদ্ধতিতে জোড়া লাগানো হয়।
ভিনিয়ারের উপযুক্ত সময় হল বৈশাখ- জ্যৈষ্ঠ। তবে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত করা যাবে।
- ভিনিয়ার পদ্ধতিতে কলম প্রস্তুত করতে চাইলে সায়নের যে সকল বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে তা হলঃ
- সতেজ, সবল, সুস্থ, চলতি মৌসুমের ডাল বেছে নিন।
- ডালটি অবশ্যই রোগ ও পোকামাকড় মুক্ত হতে হবে।
- সায়ন অবশ্যই পরিপক্ক হতে হবে।
- সায়ন শাখায় কুঁড়ি ঠিক ফোটা-ফোটা অবস্থায় নিতে হবে।
- সায়ন সাধারণত ৪-৬ ইঞ্চি হলে ভাল হয়।
রুটস্টক প্রস্ত্ততি
Ø ছয় থেকে বার মাস বয়সের রুটস্টক উত্তম। তাই আম্ন বয়সি রুটষ্টক বেছে নিন।
Ø রুটস্টকটি অবশ্যই সবল, সতেজ, রোগ ও পোকামাকড়মুক্ত হতে হবে।
Ø প্রথমে রুটস্টকের উপযুক্ত স্থানে অর্থাৎ-
Ø যেখানে খয়েরী ও সবুজ রং এর মিশ্রণ ঘটেছে (তবে জোড়ার অংশ মাটির যত নিকটবর্তী হবে ততই ভাল)খুজে নিন।
Ø উক্ত জায়গায় প্রথমে ব্যাসের এক চতুর্থাংশ আড়াআড়ি করে ৩-৪ সে.মি. জায়গায় বাকলসহ কাঠ কেটে উঠয়ে নিন।
Ø পরবর্তীতে উক্ত কর্তিত অংশের নিচে একটি বিপরীতমুখী কাটা দিন।
সায়ন প্রস্ত্ততি
Ø অনুরুপভাবে সায়নের নিচের অংশে একটি ৩-৪ সে. মি. আড়াআড়ি কাটা দিতে হবে এবং এর বিপরীতে একটি কাটা দিন।
Ø সায়নের সমস্ত পাতা একটু বোঁটা রেখে কেটে ফেলুন।
Ø এখন সায়ন রুটস্টকের উপর এমন ভাবে বসাতে হবে যেন একটি অপরটির উপর মিশে যায়।
Ø এরপর জোড়া লাগানো অংশ পলিথিন টেপ দিয়ে পেঁচিয়ে দিতে হবে।
Ø এখন সম্পূর্ণ জোড়া লাগানো অংশ সায়নসহ পলিথিন দিয়ে ঢেকে চিকন দড়ি বা সুতলির সাহায্যে সহজ গিরা দিয়ে এমনভাবে বেঁধে দিতে হবে যেন প্রয়োজনের সময় সহজে পলিথিন খুলে পলিথিনের মধ্যে জমা থাকা পানি বের করে দেয়া যায়।
Ø ৩০-৬০ দিন পর যখন সায়নের অগ্রভাগের পাতা হালকা সবুজাভ হবে তখন পলিথিনের আবরণ খুলে দিন।
Ø যখন সায়ন পুনরায় পাতা দেওয়া শুরু করবে তখন রুটস্টকের উপরের অংশ কেটে দিন।
Ø ৬-৭ মাস পরে জোড়া লাগানো অংশ যখন সম্পূর্ণ লেগে যাবে তখন ধারালো ব্লেড দিয়ে কেটে পলিথিনের বাঁধন সরিয়ে ফেলুন।
আম গাছের জোড় কলম পদ্ধতি এবং ভিনিয়ার গ্রাফটিং এই দুইটি পদ্ধতি আপনি অনুসরণ করলে আপনার ছাদবাগানে অনায়াসে আম উৎপাদন করে খেতে পারবেন।
- জেনে নিন গোল মরিচের ১০ টি চমৎকার উপকারিতা - September 11, 2020
- মালবেরি বা তুঁত চাষ পদ্ধতি - May 23, 2020
- ছাদবাগানে আম চাষ – আম গাছের জোড় কলম পদ্ধতি - March 20, 2020