বেগুন বাংলাদেশের একটি প্রধান সবজি। বেগুনের বহুবিধও ব্যবহার একে করেছে প্রসিদ্ধ। বেগুন খুবই পুষ্টিমানসম্পন্ন সবজি। তরকারি রান্নায়, মাছের সালুনে, ইফতারের বেগুনীতে, ইলিশের সাথে গোল গোল করে ভাজা বেগুন খেতে কার না ভাল লাগে! তবে এই বেগুন চাষ করতে গিয়ে থাকতে হয় খুবই সতর্ক। পোকামাকড় ও রোগ-বালাইয়ের আক্রমণে কমে যেতে পারে বেগুনের ফলন, আক্রান্ত বেগুনের বাজারমূল্য কমে যায় সাংঘাতিক হারে। আমাদের ধারাবাহিক আয়োজনে এই পর্বে বেগুনের ৫ টি মারাত্মক রোগ নিয়ে জানব।
বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা
বেগুনের চারা রোপণের ৪-৫ সপ্তাহ পর থেকেই বেগুনের কচি ডগায় ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ শুরু হয়। সাধারণত অন্য বেগুনের জমি বা আশপাশের পুরনো শুকনা বেগুন গাছের স্তূপ থেকে পোকার মথ জমিতে আসে এবং পরে ডগা ও ফলে বংশবৃদ্ধি শুরু করে। ঋতুভেদে আক্রমণের মাত্রা বিভিন্ন হয়। গ্রীষ্মকালে এ পোকার আক্রমণ বেশি হয় উষ্ণ ও আদ্র আবহাওয়ার জন্য। শীতকালে এ পোকার আক্রমণ কম হয়।
লক্ষণ
- কীড়া, কুঁড়ি, পাতার বোটা, কচি ডগা ইত্যাদি ছিদ্র করে খেতে খেতে ভিতরে ঢুকে সুড়ঙ্গ তৈরি করে।
- সুড়ঙ্গ সৃষ্টি করার ফলে কচি ডগা ঢোলে পড়ে এবং অবশেষে মারা যায়।
- এরা ফল ছিদ্র করে ভিতরে ঢোকে ও শাঁস খায়।
- আক্রান্ত ডগা শুকিয়ে যায় এবং পাশ থেকে শাখা-প্রশাখা বের হয়।
- বেগুন কাটলে ভিতরেও পোকার মল ও পচা সুড়ঙ্গের দেখা যায়।
প্রতিকার
জৈবিক ও যান্ত্রিক পদ্ধতিতে দমন
- বেগুনের জমি গভীরভাবে চাষ করতে হবে ও আগাছা হতে দেয়া যাবে না।
- প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার আক্রান্ত ডগা ও ফল ছিড়ে ধ্বংস করতে হবে।
- জমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
- ১ লিটার পানিতে ৫০ গ্রাম আধাভাঙ্গা নিমবীজ ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে, ছেঁকে আক্রান্ত গাছে ১০ দিন পর পর ৩ বার স্প্রে করলে এই পোকা নিয়ন্ত্রন করা যায়।
- সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে পুরুষ মথ ধরে এদের বংশ বিস্তার রোধ করা যায়।
রাসায়নিক পদ্ধতিতে দমন
- রিলোড ১৮ এস সি ৫ মিলি প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে।
- অথবা ফাইটার ২.৫ ই সি ১৫ মিলি প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে।
- অথবা কট্ ১০ ই সি ১০ মিলি প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে।
- অথবা কেয়ার ৫০ এস পি ১২ গ্রাম প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে।
- অথবা প্রোটেক্ট ৫০ এস জি ১০ গ্রাম প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে।
বেগুনের ক্ষতিকর কাঁঠালে পোকা
কাঁঠালে পোকা ক্ষতিকর । মা পোকা পাতার নিচের পিঠে ডিম পারে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়ে পাতা জালের মতো করে খায়। বাচ্চার গায়ে সজারুর মতো কাঁটা থাকে।এ পোকার পূর্ণ বয়স্ক বিটল ও গ্রাব উভয়ই পাতা খায়।
লক্ষণ
- আক্রান্ত পাতা ঝাঁঝরা করে
- পাতা শুকিয়ে যায় এবং ঝরে পড়ে
- অতিরিক্ত আক্রমণে পুরো গাছের পাতা জালের মতো হয়ে যায়
প্রতিকার
- প্রতিকারের জন্য ক্ষেত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
- গাছে ছাই ছিটাতে হবে।
- পরজীবি বোলতা সংরক্ষণ করতে হবে।
- ডিম ও কীড়া নষ্ট করা এবং পোকা সংগ্রহ করে মেরে ফেলতে হবে।
- শতকরা ১০ ভাগ পাতা পোকা দ্বারা আক্রাšহলে প্রতি লিটার। পানিতে ডেনিটল/ট্রিবন-১ মিঃ লিঃ বা সুমিথিয়ন- ২ মিঃ লিঃ বা সেভিন- ২ গ্রাম মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
বেগুনের পাতামোড়ানো পোকা
গাছের পাতা তাদের অক্ষরেখা বরাবর গুটিয়ে যায়। লার্ভা এখানকার কোষকলা খেয়ে বড় হতে থাকে।
লক্ষণ
- কীড়া অবস্থায় পাতা মোড়ায় এবং সবুজ অংশ খায় ।
- পাতা বাদামী বর্ণ ধারণ করে।
- পাতা দুর্বল হয়ে শুকিয়ে যায়।
- পত্রমোচন ঘটে।
- এটি সাধারণত কচি পাতাগুলো আক্রমণ করে থাকে।
প্রতিকার
- ক্ষেত পরিস্কার পরচ্ছন্ন রাখতে হবে।
- ক্ষেতে ডাল পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করতে হবে ( বিঘা প্রতি ৮-১০ টি);
- নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন করে আক্রমণের শুরুতেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
- আক্রন্ত পাতা সংগ্রহ করে ধ্বংস করে ফেলতে হবে ।
- আক্রমণ বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে সুমিথিয়ন বা ফলিথিয়ন-২ মিঃলিঃ মিশিয়ে ভালভাবে স্প্রে করতে হবে।
ছাতরা পোকা
সাদা রঙের তুলার মতো পদার্থ দেখা যায় পাতা, কান্ড, ফুল ও ফলের উপর।ফলে গাছ থেকে মধুর মতো নির্যাস বের হয় ফলে ব্যকটেরিয়া ও ছত্রাকের আক্রমণ হয়।
লক্ষণ
- এই পোকা আক্রান্ত গাছের বাড়ন্ত ডগা এবং মুকুল থেকে রস চুষে খায় কচি ডগা ও মুকুল শুকিয়ে যায় এবং ফল ধারন বিঘ্ন সৃষ্টি করে।
- ফল ধারণ করলেও খুবই দুর্বল হয়, সামান্য বাতাসেই কচি ফল ঝড়ে পড়ে। সাধারণত এরা দলবদ্ধভাবে থাকে এবং ডগা ও মুকুলের বোঁটায় এমনভাবে গাদাগাদি করে থাকে যে আক্রান্ত ডগাটিই আর দেখতে পাওয়া যায় না।
- অধিক পরিমাণে আক্রান্ত হলে এদের নিঃসৃত মধুরসে শু্যঁটিমোল্ড রোগ হয় ফলে পাতা কালো হয়ে যায় এবং ঠিকমতো খাদ্য তৈরি হয় না এবং আক্রান্ত গাছ অত্যন্ত দুর্বল প্রকৃতির হয় এবং গাছে ফলন অত্যন্ত কমে যায়।
প্রতিকার
- বাগানে জন্মানো আগাছা ও অন্যান্য গাছ তুলে ফেলতে হবে।
- গ্রীষ্মকালে বাগান ভালো করে চাষ দিতে হবে বা পূর্ববর্তী বছরে আক্রান্ত গাছসমূহের গোড়ার মাটি কোদাল দিয়ে আলগা ও এপিঠ-ওপিঠ করে দিতে হবে যাতে মাটির নিচে থাকা ডিম উপরে উঠে আসে এবং পাখি ও অন্যান্য শিকারী পোকার তা খেয়ে ফেলে।তাছাড়া অধিক রোদে পোকার ডিম নষ্ট হয়ে যায়।
- যেহেতু নিম্ফগুলো গাছ বেয়ে ওপরে উঠে তাই নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ হতেই গাছের গোড়ায় মাটি থেকে ১ মিটার উঁচুতে ৮-১০ ইঞ্চি চওড়া প্লাস্টিকের পিচ্ছিল ব্যান্ড গাছের চতুর্দিকে ঘিরে দিলে এরা বার বার ওঠার ব্যর্থ চেষ্টা করে অবশেষে মারা যায়। অনেক সময় প্লাস্টিকের পিচ্ছিল ব্যান্ডের নিচের অংশে নিম্ফগুলো জমা হয়। এ অবস্থায় এদের সহজেই পিটিয়ে বা একসাথে করে আগুনে পুড়িয়ে মারা যায় অথবা জমাকৃত পোকার উপর কীটনাশক স্প্রে করে দমন করা যায়। এসময় নিম্ফগুলোকে গাছে উঠা হতে নিবৃত করতে পারলে এ পোকার আক্রমণ পুরোপুরিভাবে দমন করা সম্ভব।
- যদি কোনো কারণে নিম্ফগুলো গাছ বেয়ে উপরে উঠে যায় তবে শুধুমাত্র গাছের আক্রান্ত অংশে সংস্পর্শ ও পাকস্থলী কীটনাশক বিধি মোতাবেক প্রয়োগ করা প্রয়োজন। তবে প্রাথমিকভাবে অল্প কিছু পরিমাণ নিম্ফ গাছ বেয়ে উপরে উঠে গেলে কেবলমাত্র গুঁড়া সাবান মিশ্রিত পানি (প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম হারে) স্প্রে করে এ পোকার আক্রমণ রোধ করা সম্ভব। তবে ব্যাপকভাবে আক্রমণের ক্ষেত্রে কীটনাশক প্রয়োগের করতেই হবে।যেহেতু এ পোকাটির বহিরাবরণ ওয়াক্সি পাউডার জাতীয় পদার্থ দিয়ে সুরক্ষিত থাকে সেহেতু পরীক্ষিত কীটনাশক ছাড়া এটি দমন করা কঠিন। এ ক্ষেত্রে প্রথমে ক্লোরপাইরিফস (ডারসবান ২০ ইসি বা এ জাতীয় কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ৩ মিলি. হারে) এবং তার ৩-৪ দিন পর কার্বারাইল (সেভিন ৮৫ এসপি বা এ জাতীয় কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে) আক্রান্ত অংশে স্প্রে করতে হবে। প্রতি ১৫ দিন অন্তর ২-৩ বার এভাবে স্প্রে করলে এ পোকা সম্পূর্ণভাবে দমন করা সম্ভব ।
বেগুনের জাব পোকা
পূর্নাঙ্গ পোকা এবং বাচ্চা উভয়ই দেখতে ছোট আকৃতির, নরম, বাদামি অথবা বাদামি কাল রঙের।
এরা দলবদ্ধ ভাবে থাকে।
লক্ষণ
- পূর্নাঙ্গ পোকা এবং বাচ্চা গাছের পাতা, কচি কাণ্ড, ফুল ও ফলের কুঁড়ি, বোটা এবং ফলের কচি অংশের রস চুষে খায়, ফলে গাছ দুর্বল ও হলুদ হয়ে যায়।
- পাতা কুচকে যায় ।
- ফুল ও ফল অবস্থায় আক্রমন হলে ফুলের কুঁড়ি ঝরে পড়ে।
- অধিক আক্রমণে কচি ডগা মারা যায়।
প্রতিকার
- আগের ফসলের অবশিষ্ট অংশ ভালভাবে পুড়িয়ে ধ্বংস করতে হবে
- সাবানযুক্ত পানি স্প্রে করা যায় অথবা আধাভাঙ্গা নিমবীজের পানি (১ লিটার পানিতে ৫০ গ্রাম নিমবীজ ভেঙ্গে ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে ছেঁকে নিতে হবে) আক্রান্ত গাছে ১০ দিন পর পর ৩ বার স্প্রে করলে পোকা নিয়ন্ত্রন করা যায়।
- তামাকের গুড়া (১০গ্রাম), সাবানের গুড়া (৫গ্রাম) ও নিমের পাতার রস প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ব্যবহার করা যায়।
- টিডো ২০ এস এল ৫ মি.লি. ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতক জমিতে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করা যায়।
- অথবা টিডো প্লাস ৭০ ডব্লিউ ডি জি ২ গ্রাম প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতক জমিতে স্প্রে করতে হবে।
- আক্রমণ বেশি হলে- পাইরাজিন ৭০ ডব্লিউ ডি জি ৪ গ্রাম প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতক জমিতে স্প্রে করতে হবে।
- এছাড়া এই পোকার আক্রমণ প্রতিরোধ করতে আক্রমণের পূর্বে- থায়োসাইড ৭৫ ডব্লিউ ডি জি ১.৫ গ্রাম প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতক জমিতে স্প্রে করতে হবে।
- স্বাদ অক্ষুণ্ণ রেখে গোশত সংরক্ষণের উপায় - July 21, 2021
- পেঁয়াজের রোগ-বালাই ও এর দমন ব্যবস্থা – পর্ব ২ - July 18, 2021
- পেঁয়াজের রোগ-বালাই ও এর দমন ব্যবস্থা – পর্ব ১ - July 18, 2021